নীলমনি হেম্ব্রমের সবুজ স্বপ্ন
রাজশাহী থেকে অনিতা বর্মণ ও শহিদুল ইসলাম
“ভালো আছি, দিনগুলোও ভালো কাটে, বাতাস শীতল, চোখে ভাসে সবুজ, ঘুম থেকে উঠেই সবুজ দেখি, সবুজের সাথে এখন বসবাস করি।” কথাগুলো বলছিলেন নীল মনি হেম্ব্রম (৩৭)। বসবাস করেন চাঁপাইনবাগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের শুকান দিঘি গ্রামে। নাচোলের গর্ব তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলামিত্রের সেই নাচোল উপজেলা। সেখান থেকে নামমাত্র দূরত্বে আড়াইশত বছরের ঐতিহ্যবাহি আমনুরা রেল জংশন! পাকা রাস্তা থেকে নেমে উত্তর-পূর্বদিকে ভাঙ্গাচোরা আঁকাবাকা আর লাল মাটির কাঁচাপথ পেরিয়েই লাল দ্বীপের মধ্যে সবুজের ডিপির মতো ছোট পাড়াটিই লোক মুখে এখন শুকান দিঘি নামে পরিচিতি।
২০১০ সালের আগেও এখানে কোন বসতি ছিলো না। চারিদিকে উচুঁ-নীচু মাঠ আর মাঝখানে পরিত্যাক্ত শুকনা একটি পুকুর ছিলো এখানে। দিঘিটি তখন বেশিরভাগ সময় শুকনো ছিলো বলেই এই দিঘির নাম দিয়েছিলো শুকান দিঘি। স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সে সময় ভূমিহীন আদিবাসীদের বসবাসের জন্যে দিঘিসহ এর আশপাশের খাসজমিতে বসবাসের সুযোগ করে দেন। প্রথম পর্যায়ে শুকান দিঘির পাড়ে শুরু হয় নয়টি পরিবারের বসবাস। সুযোগ সুবিধা এবং পরিবার বেড়ে গিয়ে এখন ১২টি পরিবার বসবাস করে। কিন্তু পুকুরটি বছরের বেশিরভাগ সময়েই পানি থাকতো না। শুকনাই পড়ে থাকতো। ভূমিহীন আদিবাসীগণ মাথাগোজার ঠাঁই পেলেও শুকিয়ে যেতে থাকে তাদের সবুজ স্বপ্নগুলোও ।
গ্রামটির কিছু সচেতন মানুষ সমস্যা সমাধানে যোগাযোগ করতে থাকেন নানা পর্যায়ে। নিজেদের একতাবদ্ধতা এবং শক্তিই যে পারে সকল সমস্যা সমাধান করে দিতে সে সম্পর্কে ধারণা ছিলো না গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের। তবে অবশেষে তাদের সম্মিলিত শক্তিই এলাকার বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের প্রধান হাতিয়ার হয়। স্থানীয় সরকার এবং উন্নয়ন সংগঠন বারসিক’র সহযোগী ভূমিকাই গ্রামের মানুষের মনোবল, উদ্যম ও ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত করে। নিজের ইচ্ছাশক্তি এবং একাতব্ধতার গুণে গ্রামটির নারী ও পুরুষ এলাকার ওই দিঘিতে স্থায়ীভাবে সংস্কার করার জন্য ২০১৪ সালে প্রায় ২০ দিন নিজেরাই শ্রম দিয়ে দিঘিটি খনন করেন। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও শ্রমের ফলে শুকান দিঘিতে ভরে যায় জলে । সেই জল আজোও ভিজিয়ে দেয় বরেন্দ্রর রুক্ষ মাটি। আর জন্ম দেয় সবুজের প্রাণ। জাগিয়ে দেয় সবুজ স্বপ্ন। গ্রামটিতে এখন সবুজের সমারোহ। প্রতিটি পরিবারের ঘরের চালে, সানচি-কানচিতে, আনচে-কানাচে, পালানি জমিতে চোখে পড়ে সবুজের মেলা। প্রাণের খেলা।
অন্যান্য পরিবারগুলোর মতোও সবুজের সাথে জাগিয়ে দেয় নীলমনির নীল স্বপ্ন। নীলমনি একসময় রাতে ও দিনে খেটেও দিনের নাগাল পেতেন না। অভাব লেগেই থাকতো। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই পরের জমিতে পাইট (শ্রমিক) দিতেন। নতুন সংসার হয়ে এসেই পরের জমিতে ধানকাটাসহ নানা ধরনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন। পুরুষের মতো কাজ করলেও কখনো তাকে পুরুষের সমান মজুরি দেয়নি কেউ। কিন্তু একটি দিঘির জলে তার সকল স্বপ্ন সবুজ হয়ে গেছে। সংসারে দু’জন সন্তান, একজন লেখাপড়া করে। ছোট সন্তানটি এখনো স্কুল উপযুক্ত হয়নি। তাঁর স্বামী জমিতে কাজ করেন। নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এবং শুকান দিঘির জলকে কাজে লাগিয়ে নীল মনি হেম্ব্রম বাড়িতে, ঘরের চালে, আশপাশে সবজি চাষ করেন। দিঘির জলে হাস পালেন। বাড়িতে মুরগি পালেন। দিঘির জলের কারণেই তিনি এখন গরু পালন করেন। দিঘির জলের কারণেই তিনি এখন ছাগল পালেন বলে জানান।
দিঘির জল ব্যবহার করে বহুমূখী অর্থনৈতিক কাজের সাথে জড়িত থাকার কারণে নীলমনির পরিবোরের আয় বেড়ে গেছে। তিনি এখন ঘরে ও বাইরে তার নিজস্ব কাজগুলো করেই বেশি উন্নতি করছেন। আবাদকৃত শাকসবজি যেমন তার পারিবারিক সবজি ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে ঠিত তেমনি উদ্বৃত্ত সবজি এবং হাস মুরগির ডিম, গরুর দুধ এবং ছাগল বিক্রি করে বাড়তি আয়ও করছেন। দুর্যোগ সময়ে সেই অর্থ বন্ধু হয়ে দেখা দেয়। নীল মনি বলেন, “এক সময় দিঘির ধারটিতে এতো সবুজ ছিলো না, পানিও থাকতো না সারাবছর, কতো যে কষ্ট হতো। আর এখন দিঘির চারিধারেই সবুজ আর সবুজ। পেয়ারা, চালতা, লিচু, আতা, আমড়া, জাম, বরই, কলা, লেবু, ডালিম, আম, কাঁঠাল, তালসহ নানা ফলের গাছ। সকালে উঠে পুকুর ধারে বসলেই সবুজ হয়ে যায় মনটি।”
বরেন্দ্র অঞ্চলের রুক্ষ মাটিতে দিঘির জলে সবুজ ফিরে পায়। দিঘিই বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্য, দিঘিই বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাণের উৎস। তাই বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামভিত্তিক পুকুর/দিঘিগুলো গ্রামের মানুষের তত্বাবধানে দিলে গ্রামের মানুষগুলো নিজেদের উদ্যোগেই নিজেদের প্রয়োজনেই সেটিকে জীবিত রাখবে, নিজেরাও উন্নয়নে এগিয়ে যাবে। গ্রামকে উন্নয়ন করতে ব্যয় করতে হবে না আলাদা কোন বাজেট। সবুজ স্বপ্ন এবং সবুজ বরেন্দ্র করতে পুকুর/ দিঘিগুলোর যতœ ও ব্যবস্থাপনা ফিরে পাক নীলমনির মতো মানুষগুলো ।