হাতের কাজটি করতে পেরে আমরা গর্বিত
কলমাকান্দা, নেত্রকোণা থেকে গুঞ্জন রেমা
একটি গ্রাম, যে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বাঁশ ও বেতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। স্ত্রীরা সংসারের আর্থিক সমস্যা স্বামীর দিকে চেয়ে না থেকে নিজেই নিজের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। গ্রামটি কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। যার নাম ভেলুয়াতলী গ্রামের নারীরা।
এই গ্রামে বেশির ভাগ নারী সংসারের কাজকর্ম শেষ করে বাঁশ-বেতের কাজ করেন। বিভিন্ন ধরনের বাইর, দাড়ি, পাখা, শীতলপাটি, খাঁচা, চুকরাসহ আরো অনেক ধরনের বাঁশের গৃহস্থালী জিনিসপত্র তৈরি করে নিজে ব্যবহার করছেন এবং বাজারে বিক্রি করে আয় করছেন। যার জন্যই সংসারের কোন কিছু প্রয়োজন হলে নারীরা স্বামীর কাছে চেয়ে তাঁর অনুগ্রহের জন্য বসে থাকতে হয় না। তাদের এই বাঁশ-বেতের কাজ তারা প্রতিদিন আপন মনে করে যাচ্ছেন।
বেশির ভাগই তারা বাইর বানিয়ে সময় কাটান। বাইর বানানোটাকে তারা বড় আপন করে নিয়েছেন। সারাক্ষণই তাঁরা হাতের কাজ করে যাচ্ছেন। বসে থাকার মত তাদের হাতে কোন সময় নেই। তাঁদের দিন শুরু হয় বাঁশ-বেতের কাজ করে এবং দিন শেষও হয় বাঁশ ও বেতের কাজ করে। এভাবেই তাদের প্রতিটি মূহুর্ত কেটে যায় হাতের কাজের (কুটির শিল্পের) মধ্য দিয়ে।
বাইর বিভিন্ন প্রকারের হয়। কখন কোন বাইর বানানো হবে সেটি করা হয় মৌসুম বুঝে। মৌসুমের শুরুতে তারা তৈরি করেন গোল বাইর (পেসা বাইর)। কারণ এই সময় এই বাইর’র চাহিদা বেশি থাকে। আর মৌসুমের শেষের দিকে তাঁরা তৈরি করেন দরি বাইর। এই এলাকা যেহেতু ভাটি প্রধান এলাকা। তাই ভাটি এলাকার পানি কমা শুরু হলে দরি বাইর ব্যবহার করা হয়। এমন করেই সারাবছর এই গ্রামের নারী ও পুরুষরা বাইর বানিয়ে থাকেন। শুকনো মৌসুমে বাইর বানিয়ে জমা করে রাখেন। তারপর যখন মৌসুম শুরু হয় তখন বাইর বিক্রি করা শুরু করেন বলে জানান হাসিনা বেগম। প্রতিটি পেসা বাইর বিক্রি করেন ৪০-৮০ টাকা পর্যন্ত। আর প্রতিটি দরি বাইর বিক্রি করেন ৫০-১৫০ টাকা পর্যন্ত।
বাঁশ-বেতের কাজ করলেও নিজেদের বাগানে তেমন বাঁশ নেই; যার জন্য বাঁশ কিনে কাজ করতে হয়। তাই বাঁশ রোপণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন আব্দুল মোতালিব। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “যা দিয়ে কাজ করা হয় সেটি যদি না থাকে তবে একদিন আমাদের এই শিল্প হারিয়ে যাবে।”
তাদের এই হাতের কাজটিকে উৎসাহিত ও সম্মান প্রদর্শনের জন্যই বারসিক ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ তারিখে ভেলুয়াতলী গ্রামে কুটির শিল্প মেলার আয়োজন করা হয়। মেলায় ৩০টি স্টল প্রদর্শিত হয়। প্রদর্শিত স্টলে দেখা গেছে বিভিন্ন ধরণের বাইর, শীতলপাতি, চালুন, কোলা, চুকরা, পাখা, খাঁচা, দাড়ি, বিভিন্ন ধরণের মাছ শিকারের উপকরণসহ অনেক ধরণের কুটির শিল্প পণ্য। এগুলো তারা নিজেরা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে থাকেন।
এই ৩০টি স্টলের মধ্যে নারীদের স্টল ছিল ২৬টি আর পুরুষের ছিল ৪টি। নারীরা প্রতিদিন সংসারের বিভিন্ন ঝামেলা সামাল দিয়ে অবসর সময়ে বাঁশ বেতের কাজ করে আয় করে চলেছেন। মেলায় নিয়ে আসা এই পণ্যগুলো যারা তৈরি করেছেন তাদের মধ্যে হালেমা বেগম বলেন, ‘আমাদের এই হাতের কাজটি করতে পেরে আমরা গর্বিত। কারণ আমরা এ কাজটি না করলে স্বামীর কাছে হাত পাততে হতো। কিন্তু এখন আর হাত পাততে হয় না। বরং স্বামীদের সহায়তা করি।’ নিজেই কাজ করছেন, অর্থ উপার্জন করছেন। সংসারের বিভিন্ন অর্থিক সমস্যা দূর করতে পারছেন বলে অনেকে জানিয়েছেন। স্বামীর আয়ের উপর নির্ভর না করে বরং স্বামীকে সংসার পরিচালনায় সহযোগিতা করতে পারছেন। এটি তাদের জন্য বড় পাওয়া ও গর্বের বিষয়।
স্বামী সংসার সবই সামাল দিতে হয় একজন নারীকে। তারপরও আয়মূলক কাজে নিজেকে সম্প্ক্তৃ করতে হয়। যে সমাজে নারীরা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হয় সে সমাজে ঘরে বসে আয় করাটা খুবই জরুরি। নারীরাও যে ঘরে বসে হাতের কাজ করে সংসার পরিচালনায় অবদান রাখতে পারেন তার উদাহরণ এই ভেলূয়াতলী গ্রামে নারীরা।