বাগান প্রেমী এক দম্পতির গল্প
সাতক্ষীরা থেকে মো. আসাদুজ্জামান সরদার:::
কংক্রিটের দেওয়াল-ঘেরা বাড়িটার দিকে চোখ গেলে মনে হয়, গাছগাছালিতে ভরা। ছাদের দিকে তাকালে মনে হয়, যেন ফাগুনের ছোঁয়া লেগেছে তাতে। আর ভেতরে গেলে অবাক হতে হয়, যেন এটি বাড়ি নয়, পুরো একটি নার্সারি!
সাতক্ষীরা শহরের উপকণ্ঠের লাবসা এলাকায় চোখ জুড়ানো এ বাড়িটি অবস্থিত। এটির মালিক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার শেখ মনিরুজ্জামান ও তার স্ত্রী শাহিনা আক্তার। এই দম্পতি তাদের তিন হাজার দুইশ বর্গফুট বাড়ির ছাদে কয়েকশ গাছগাছালির একটি বাগান গড়ে তুলেছেন। পরম যত্নে গড়ে তোলা এ বাগানটি দেখলে বোঝা যায়, গাছগাছালির প্রতি এই দম্পতির রয়েছে অগাধ ভালোবাসা! তিনতলা এই বাড়ির দুটি ছাদ। দোতলাতে একটি ও অপরটি তিনতলায়। বাগান করার জন্যই এই দম্পতি বাড়িতে দুটি ছাদ তৈরি করেছেন। এ কারণে এলাকার মানুষের কাছে বাড়িটির পরিচয় এখন ‘কৃষিবাড়ি’ হিসেবে।
শেখ মনিরুজ্জামান-শাহিনা দম্পতি বলেন, “বাড়ির ছাদে বাগান করা খুব একটা কঠিন কাজ না। ইচ্ছে করলে যে কেউই ছাদে ফলমূল, শাকসবজির বাগান তৈরি করতে পারেন। এতে করে শাকসবজির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কোনো পরিবার আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী হতে পারে।”
সরেজমিন দেখা যায়, বাড়িতে ঢোকার পথেই রয়েছে, সারি সারি ঝাউগাছ। রয়েছে আম ও আমড়াগাছ। এর পাশেই রয়েছে আবার কামরাঙ্গা গাছ। রয়েছে টক ও মিষ্টি বরই গাছ। মাটির ওপর বানানো মাচানে ঝুলছে, বড় বড় বেশ কয়েটা লাউ। প্রায় এক বিঘা জমিতে ভরপুর বিভিন্ন ফলদ, বনজ ও ঔষধিগাছ। কোথাও একটুও ফাঁকা নেই। এখানে একটি ছোট পুকুরও দেখা গেল। মাছ চাষ করা হয়েছে এটিতে।
তবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ বাড়ির ছাদ দুটিকে ঘিরে। বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে চক্ষু ছানাবড়া। মৌসুমী শাকসবজি আর ফুল আর ফলে ভরে গেছে ‘কৃষিবাড়ি’র ছাদের বাগান।
ছাদে চেরি ও শিউলি ফুল দেখে শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের গানের কলি মনে পড়ে গেল- ‘ওগো বিদেশিনী, তোমার চেরি ফুল দাও, আমার শিউলি নাও/দুজনে দুজনে হই ঋণী।’
এই দম্পতি আরো বলেন, “তাদের বাড়ির ছাদ দুটিতে রয়েছে ২২ প্রজাতির গোলাপ, ডালিয়া, জিনিয়া, পেনজি, পাফায়ার বলসহ দেশি-বিদেশি ফুল। রয়েছে হাসনা হেনা, সাপে কাটার ঔষধি গাছও। তুলসী, ঘৃতকুমারী, রক্ত করবী গাছও লাগানো রয়েছে ছাদে। টবের গাছে কমলালেবু, মালটা ও টমেটো ধরেছে। গাব, ঝাউগাছ ও ভূতেরগাছ হিসেবে পরিচিত ‘শাড়া’ গাছও লাগানো হয়েছে। ছাদে বাতাবিলেবু, কদবেল, দেশিবেল, পামফলসহ অসংখ্য ফলদ গাছ লাগানো হয়েছে। থোঁকা থোঁকা মাল্টা পেকে হলুদ হয়ে রয়েছে।”
লাল বাগানবিলাস ও হলুদ গাঁদা ফুলে মনে হচ্ছে ছাদে যেন ফাগুনের আগুন লেগেছে। বাড়ির ছাদ আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, সুন্দরবনের গেওয়া, সুন্দরী গাছে। শুধু তাই-ই নয়, অর্কিড কর্নারে বড় বড় ক্যাকটাস দেখলে যে কারো মন ভরে যাবে। ঘরের ভেতরেও বেশ কয়েকটি ইনডোর প্ল্যান্ট দেখা গেল।
সুন্দর করে সাজানো বাড়িটির নাম রাখা হয়েছে, ‘প্যাসিফিক প্যালেস’। শান্ত-সুনিবিড় ছায়াঘেরা বাড়িটির দোতলায় উঠে পূবদিকে তাকালে চোখে পড়ে আদিগন্ত ফসলের মাঠ। শেখ মনিরুজ্জামান ও শাহিনা দম্পতির করা বাগানটি জেলার সেরা ছাদবাগান নির্বাচিত হয়েছে। তাদের ছাদের ওপর বাগান দেখে এলাকার অনেকেই ছাদে বাগান করার প্রতি অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।
তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা দুজনই ছোটবেলা থেকে বাগান করতেন। মেধা, মনন ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে তারা গড়ে তুলেছেন এই ‘প্যাসিফিক প্যালেস’। প্যালেসটিকে দেখাশোনায় স্ত্রী শাহিনাকে সাহায্য করেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার স্বামী মনিরুজ্জামান। তাদের দুই ছেলে। বড় ছেলে হাসানাত ৮ম শ্রেণিতে ও ছোটছেলে আরাফাত ২য় শ্রেণিতে পড়ে। তারাও বাগান পরিচর্যায় মা-বাবাকে সাহায্য করে।
শেখ মনিরুজ্জামান ও শাহিনা বলেন, “এলাকার কারো কিছু হলে আমাদের বাড়িতে আসেন। সর্দিকাশি হলে শিউলি ফুল, আমাশয় হলে থানকুনিসহ বিভিন্ন ঔষধি গাছ নিয়ে যান তারা।”
তাদের বড় ছেলে হাসানাত বলে, “মায়ের সাথে বাগান পরিচর্যার কাজ করি। এলাকার অনেকে বলেন, ‘কৃষিবাড়ি!’ তখন শুনতে অনেক ভালো লাগে। এলাকার সবাই আমার মা ও বাবার কাজের অনেক প্রশংসা করেন।”
মনিরুজ্জামান বলেন, “আমি বছরের অর্ধেক সময় জাহাজে থাকি। তারপরও যে সময়টা বাড়িতে থাকি, বাগান নিয়ে পড়ে থাকি। সমুদ্রে থাকলে কী হবে, সেখানেও (জাহাজে) বাগান করেছি। আমার বাবা বাগান করতেন। তা দেখে সেই ছোটবেলা থেকেই বাগানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি।” তবে সব কৃতিত্ব তার স্ত্রীকে দিয়ে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকি। আর ও (শাহিনা আক্তার) বাগানের দেখভাল করে।”
মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বনসাইয়ের কারিগর উৎপল সম্পর্কে আমার ভাগ্নে হন। তার কাছ থেকে বনসাই তৈরি করার কিছু পদ্ধতি শিখে বেশ কয়েকটি বটগাছের বনসাই তৈরি করেছি। আমাদের বাড়িতে কোনো মেহমান আসলে আগে ছাদে ওঠেন। ছাদটি এখন আমাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের পছন্দের জায়গা।’
শাহিনা আক্তার মনে করেন, বাগান পরিচর্যা প্রতিদিনের গৃহস্থালি কাজের মতোই হয়ে গেছে। একদিন কাজ না করলে মনে হয়, কিছু একটা কাজ করা হয়নি। গাছগুলো যেন তাদের কাছে একেকটি সন্তানের মতো হয়ে গেছে।
বৃক্ষপ্রেমী ও প্রাণ-প্রকৃতির অকৃত্রিম বন্ধু এই দম্পতিকে বারসিক নিউজ এর পক্ষ থেকে অভিবাদন।