মানিকগঞ্জে মুদ্রণ শিল্পের দিনকাল
মানিকগঞ্জ থেকে এম. আর. লিটন:
যুগের সাথে তালমিলে অনেক কিছু পরিবর্তন হচ্ছে বা আরও অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে। আর গতিশীল পৃথিবীর এটাই নিয়ম। বিশ্বায়নের ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সম্প্রসারণ ঘটছে। অন্যদিকে তথ্য প্রযুক্তি ও মুদ্রণ শিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ হয়েছে।
আমরা জানি, পৃথিবীর আদিকালে মানুষ তার মনের ভাব এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পাথরে খোদাই করে লিখে রাখতো- তখন মুদ্রণ যন্ত্র ছিল না। পরবর্তীতে মানুষ তার উন্নত চিন্তা ও গবেষণার মধ্যদিয়ে মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার করে। কালের পরিক্রমায় মুদ্রণ যন্ত্র বিকশিত হয়ে এখন শিল্প হিসেবে রুপ নিয়েছে। মুদ্রণ শুধু ছাপার কাগজ আর নানা রঙের কালীতেই সীমাবদ্ধ নয়। এই মুদ্রণের কাজ করে হাজারও মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে ।
মানিকগঞ্জ একটি ছোট শহর। এখানেও গড়ে উঠেছে কয়েকটি মুদ্রণ শিল্প। এই শহরে প্রথম যে মুদ্রণ শিল্পটি স্থাপিত ছিল তার নাম ‘মানিকগঞ্জ প্রেস’। মানিকগঞ্জের অনেকে কর্মজীবনের অবিলম্বন হিসেবে মুদ্রণ শিল্পকে বেছে নেন এই প্রতিষ্ঠানটির হাত ধরে। যদিও বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি আর নেই।
কক্ষন, কোন ব্যক্তির হাত ধরে মানিকগঞ্জে এই শিল্পের আগমন তা স্পষ্ট নয়। তবে জানা যায় যে, এর অনেকেই অধিবাসী ছিল অবিভক্ত ভারতের। মানিকগঞ্জের অনেক প্রেস ব্যবসায়ী আগে ভারতে এই শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৬-৪৭ এর ভারত বিভক্তির পর তাঁদের অনেকেই ঢাকায় কিংবা মানিকগঞ্জে ফিরে আসেন এবং কেউ হয়তো নতুন করে উক্ত ব্যবসা শুরু করেন, আবার কেউ বা একই জাতীয় পেশায় চাকুরিতে নিয়োজিত হন।
মানিকগঞ্জ জেলায় যে কয়টি মুদ্রণ শিল্প গড়ে উঠেছে এর মধ্যে মানিকগঞ্জ প্রেস, উদয়ন প্রিন্টিং প্রেস, রূপা আর্ট প্রেস, শরৎ প্রেস, প্রগতি প্রিন্টং প্রেস, প্রেস হাউস, মর্ডান আর্ট আর্ট প্রেস, তাজ প্রিন্টিং প্রেস, ইউনাইটেড প্রেস, পারিল প্রিন্টিং ওয়ার্কস, জনতা আর্ট প্রেস, বন্ধু আর্ট প্রেস, উজ্জল আর্ট প্রেস, নমুনা আর্ট প্রেস প্রভৃতি। এর মধ্যে অনেক প্রেস বন্ধ হয়ে গেছে এবং কিছু নতুন গড়ে উঠেছে ।
এই মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ছাপার কাজ করে। যেমনঃ পোস্টার, লিফলেট, ক্যাশমেমো, ভিজিটিং কার্ড, ছোট পুস্তিকা ইত্যাদি। এছাড়াও অনেকগুলো আর্ট-এর দোকান দেখা যায়, হস্তশিল্পের মাধমে কাপরের ব্যানার, সাইনবোর্ড লেখা, টি-শার্টে ও শফিং ব্যাগে ছাপ দেয়া সহ বিভিন্ন মুদ্রণ কাজ করে থাকে। ইদানিং প্রযুক্তির কল্যাণে মানিকগঞ্জে প্রসার ঘটেছে ডিজিটাল ব্যানার বা প্যানা তৈরির কাজ।
মানিকগঞ্জ একটি অনুন্নত শহর বলে এখানে প্রেস ব্যবসা এখনো জমে উঠেনি । যে সকল মুদ্রণ শিল্প এখানে আছে সেগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় এবং পদ্ধাতিগত দিক থেকেও আধুনিক নয়। সেই সাথে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে জেলা শহর হওয়াতে প্রায় ছাপার কাজগুলো ঢাকা থেকে করা হয় ।
মানিকগঞ্জে মুদ্রণ শিল্পর সাথে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং শিল্প-সাহিত্যের তেমন কোন প্রভাব বা সম্পর্ক ছিল বলে তেমন ঞ্জির মেলে না। কিন্তু লক্ষ্য করা যায়, নির্বাচনের প্রচারপত্র, হালখাতা এবং বিবাহের অনুষ্ঠানের চিঠিপত্র মুদ্রণে প্রেসগুলোতে ভীড় জমে। বর্তমানে মুদ্রণ শিল্প সম্পর্কে উক্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এসব মুদ্রণ শিল্পে দক্ষ লোকবল প্রয়োজন। কিন্তু মানিকগঞ্জে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ লোকবল সীমিত। এসব প্রতিষ্ঠানে যে সকল লোকবল কাজ করে তারা স্বল্প শিক্ষিত।পাশাপাশি সমাজে তাঁদের মূলায়ন তেমন নেই। যার ফলে এই মুদ্রণ শিল্পে কাজ করতে নতুন প্রজন্ম আগ্রহ প্রকাশ করে না ।
জানা জায়, ষাট ও সত্তরের দশকে মুদ্রণ শিল্পের একজন শ্রমিক মজুরি পেয়েছে ১৫ থেকে ৫০ টাকা । কিন্তু সময় ও চাহিদার পরিবর্তন ঘটলেও বর্তমানে একজন মুদ্রণ শ্রমিক মজুরি পায় সর্বোচ্চ দশ থেকে এগার হাজার টাকা । এর মধ্যে অনেক মজুরি কাজের উপর নির্ভর করে। যেমনঃ কম্পিউটার অপারেটরের মজুরি ছয়-সাত হাজার, মেশিন চালকের মজুরি দশ হাজার এবং বাঁধাই এর মজুরি পাঁচ-ছয় হাজার টাকা পান একজন শ্রমিক। এই স্বল্প মজুরিতে কাজ করে অনেকে তাঁর জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে না । যার ফলে বাধ্য হয়ে এই মুদ্রণ শিল্প থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে ।
তারপরও এখনো অনেকে আশাবাদী। এই শিল্পের ভবিষ্যৎ হতাশাব্যঞ্জক নয়। দক্ষ লোকবল নিয়োগ এবং আধুনিকতার মাধ্যমে মুদ্রণ শিল্প ফিরে পাবে তার নতুন প্রাণ ।