অনাবৃষ্টি ও উপকূলীয় কৃষি সংকট

অনাবৃষ্টি ও উপকূলীয় কৃষি সংকট

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান

জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গোটা দক্ষিণ উপকূল অঞ্চলের নদ-নদী ও কৃষি জমিতে। ঝড়, বন্যা, খরা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করছে উপকূলের মানুষ। একটির পর একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকুলে আঘাত আনছে। নদী ভাঙ্গনের ফলে প্রতি বছর চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষক। দেশের দক্ষিণ উপকুল জুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বেড়ে যাচ্ছে তেমনি বৃষ্টিপাত কম হওয়াই পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। যদিও এই লেখাটি যখন পাঠক পড়ছেন- তখন সারা দেশে বৃষ্টির শীতল আভাস পেয়েছেন। সেটাকে যতটা না বৃষ্টি বলা যায় তার চেয়ে বেশি মৌসুমী ঝড় বলা চলে।

drought অনাবৃষ্টি ও উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিতে কি ধরনের সংকট তৈরী হচ্ছে সেটা নিয়ে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার শ্যামনগর, ঈশ্বরীপুর, রমজাননগর, মুন্সিগঞ্জ, আটুলিয়া, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালী, কাশিমাড়ি, ভুরুলিয়া ও গাবুরা ইউনিয়নের ১৩৭ জন কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে আলোচনা ও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দলীয় এবং একক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহের কাজটি চলে। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, অনাবৃষ্টি ও অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে চাষাবাদের সময়কাল সঙ্কুচিত হচ্ছে। ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বীজের অঙ্কুরোদগম কম হচ্ছে। গাছের দৈহিক বৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। ফুল ও ফল কম হচ্ছে। ফসল পরিপক্ক কম হচ্ছে। ফলের আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ফসল পেকে যাচ্ছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে ফসলের পাতা বুটে (গুটিয়ে দলা হওয়া) যাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বোরো ধানের ক্ষেতে যেখানে সেচের বিকল্প ব্যবস্থা নাই সেখানে আগাম থোড় ধরছে। হঠাৎ তাপমাত্রা উঠানামা করার ফলে হাঁস-মুরগীর ডিম উৎপাদন কমে যাচ্ছে। গরমের ক্ষেত্রে একই রকম ঘটছে। বিশেষ করে বৃষ্টি যখন হওয়ার কথা তখন হয় না, আবার যখন হওয়ার কথা না তখন হয়।

drought-2গড়কুমারপুর গ্রামের প্রবীন কৃষক আব্দুল আজিজ বলেন, “অনাবৃষ্টির ফলে জমিতে নোনা কেটে উঠছে। ধান গাছ লাল হয়ে যাচ্ছে। সেচের পানি দিলে ও তাপের কারণে পানি দুধনুনতা হয়ে যাচ্ছে। ধান গাছ বাড়ছে কম। জমিতে সেচের পানি বেশী দিতে হচ্ছে। প্রথম দিকে সপ্তাহে একবার সেচ দিলে হতো। কিন্তু অনাবৃষ্টির ফলে এখন সপ্তাহে দুই বার সেচ দিতে হচ্ছে। আগে এক বিঘা জমিতে এক লিটার ডিজেল লাগতো। কিন্তু দীর্ঘ দিন বৃষ্টি না হওয়াই বিঘা প্রতি আড়াই লিটার ডিজেল লাগছে। পানির লেয়ার নিচে নেমে গেছে। যে কারণে স্যালোমেশিনে পানি কম উঠছে। মাটি ভাড়ে (শক্ত চাক) হয়ে যাচ্ছে।” তিনি আরো বলেন, “দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় ধানের শীষ ছোট হয়ে যাচ্ছে। ধানের শীষ বের হওয়ার পর শুকিয়ে চিটা হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়াই জমিতে রাসায়নিক সার বেশী দিতে হচ্ছে এবং জ্বালানী খরচ ও বেড়ে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টির কারণে বিঘা প্রতি ৬/৭ মন ধান কম হবে”।

drought-3অনাবৃষ্টির কারণে আমের মুকুল, কাঠালের ফুল, আমড়া, লেবুর ফুল শুকিয়ে পড়ে যাচ্ছে বলে জানান ধুমঘাট গ্রামের কৃষক সামসুর রহমান। তিনি বলেন, “অন্যান্য বছর গুলোতে এ সময় বর্ষার দেখা মিললে ও চলতি বছর মার্চ-২০১৮ মাস শেষ হলেও বৃষ্টির ফোটা চোখে পড়েনি। ফসলের পাশাপাশি গবাদি পশু বিভিন্ন ধরণের রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে; এমনকি মারাও যাচ্ছে। তা ছাড়া বর্ষা না হওয়া এবং তাপের কারণে লবণ কেটে উঠছে। চারদিকে লোনা পানির কারণে মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুও পানির সংকটে ভুগছে।”
পাতড়াখোলা গ্রামের কৃষাণ নাজমা বেগম বলেন, “আমি দিন মজুরের কাজ করি। জমি বর্গা নিয়ে কূপ পদ্ধতির মাধ্যমে বোরো ধান চাষ করি। কিন্তু এ বছর অনাবৃষ্টির কারণে কূপে আর পানি উঠছে না। সেচের অভাবে ফসল মার যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরী হয়েছে।”

drought-4দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততার আগ্রাসন বেড়েই চলেছে। কৃষি বিপর্যয়ের অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিচ্ছে লবণাক্ততার আগ্রাসী থাবা। পানির স্তর ক্রমে নিচে নেমে যাওয়াই লবণাক্ততা ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানিকে ও গ্রাস করছে। প্রতি বছর লবণাক্ততার আগ্রাসী থাবায় উপকূলীয় জনপদ ক্রমশ পরিণত হচ্ছে বিরানভূমিতে।

happy wheels 2

Comments