বরেন্দ্র কৃষকদের ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে সফলতা
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম
বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত বরেন্দ্র অঞ্চলের চাঁপাই জেলার নাচোল উপজেলা ‘ঠা ঠা ও উঁচু বরেন্দ্র’ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এই এলাকা আবহাওয়া পরিবেশ, মাটির ধরন, ফসল বৈচিত্র্যসহ অনেক কিছুই দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা। বিশেষ করে মাটির ধরণ, গুণাগুণ এবং আবহাওয়া অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মাটি লাল ও এটেল হওয়াতে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কম। বিএমডিএ’র গবেষণায় দেখানো হয়েছে এ মাটিতে শতকরা ০.৮ থেকে ১.৫ ভাগ জৈব পদার্থ রয়েছে। এ মাটিতে নাইট্রোজেন কম, ফসফরাস কম-মধ্যম, পটাশ, গন্ধক ও দস্তা কম-মধ্যম মানের রয়েছে। এ মাটি অম্ল-ধর্মী, এর পিএইচ ৫.২-৬.২। বরেন্দ্র অঞ্চলে বেলে বা বেলে দো-আঁশ জাতীয় মাটি নেই। এখানে লাল মাটি রয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি শুকনো অবস্থায় খুব শক্ত হয়। মাটির রস ধারণক্ষমতা কম। সঙ্গত কারণেই এই অঞ্চলের মাটিতে জৈবসার বেশি করে প্রয়োগ করা উচিত। আবার ফসলের বৈচিত্র্য বাড়ানোও অনেক বেশি প্রয়োজন। তাই এলাকার কৃষকগণ নিজেদের প্রয়োজনেই নানা উদ্যোগ ও চর্চাগুলো করে থাকেন।
ঠা ঠা ও উঁচু বরেন্দ্র হিসেবে নাচোল উপজেলার কসবা ইউনিয়নের খড়িবনা গ্রামটিও একই বৈশিষ্ট বহমান। রুক্ষ আবহাওয়া, অধিক তাপমাত্রা, লাল ও শক্ত এটেল মাটিসহ পানি সমস্যা কবলিত একটি গ্রাম। এই গ্রামের কৃষকদের সঙগঠিত করে নানা জ্ঞান অভিজ্ঞতা বিনিময়ে সহায়তা করেন কৃষক রায়হান কবির রঞ্জু। গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার মহেশপুর গ্রামের সফল চাষী রায়হান কবির রঞ্জু ২০১১ সালে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অধিক ফলনশীল সোহাগ-৪ ধানের আবিষ্কার করেন। পরিবেশ প্রতিবেশ উপযোগী কৃষি ও কৃষকদের নিয়েই তিনি সবসময় চর্চাগুলো করে থাকেন এবং বহুজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেন। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছরের বেশি সময় থেকে তিনি নাচোল উপজেলার খরিবোনা গ্রামে প্রত্যক্ষভাবে কৃষকদের সাথে নিয়ে বিভিন্নভাবে সহায়কের ভূমিকা পালন করছেন। এরই অংশ হিসেবে রুক্ষ এবং অধিক তাপ প্রবণ এই এলাকায় ভার্মি কম্পোস্ট এর পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেন।
প্রথম পর্যায়ে কিছু কেঁচো আর দুটি চারি দিয়ে শুরু করলেও অধিক তাপ এবং রুক্ষ আবহাওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে যায়। তবে তিনি বুঝতে পারেন কি কারণে কেঁচোগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি আবার শুরু করেন নতুন উদ্যামে। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে তিনি আবার ২০০০ কেঁচো এবং ৫টি চারি দিয়ে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘এখানে এতোই গরম আবহাওয়া যে বাতাসও গরম, আবার এতো রোদ যে গরমে চারির ভিতরে কেঁচো মরে যায়। কৃষক রঞ্জু মিয়া বলেন, ‘আমি উক্ত সমস্যা কাটতে বাতাস চলাচল করতে পারে এমন জায়গা নির্বাচন করি, ঘরের আবহাওয়া কেঁচোর উপযোগী করার জন্যে গরম মৌসুমে ছনের চালা ব্যবহার করি। যেসকল গরু প্রাকৃতিক সবুজ ঘাস খায় সেইসকল গোবরে কেঁচো মরেনা, সারের মানও ভালো হয়।’
তাই তিনি এসকল গরুর গোবর সংগ্রহ করেন। এসকল বৃদ্ধি খাটিয়ে তিনি কেঁচো সার উৎপাদনে সফলতা পান। বিগত দিনে এ পর্যন্ত ২১শ’ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট স্থানীয় কৃষকদের কাছে বিক্রি করেছেন ২৭,৩০০ টাকায়। নিজের মজুদে এখনো ৬০০ কেজি আছে। বিগত এক বছরে ৫টি চারি থেকে বর্তমান ৬৩টি চারিতে উন্নতি করেছেন। সারের উৎপাদন বেড়েছে। কৃষক রায়হান কবির রঞ্জুর এই সফলতা এলাকার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের পক্ষ থেকে তার এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নাচোল উপজেলায় কেঁচো সারের সম্প্রসারণ ঘটানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে নাচোল উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপজেলা কৃষি অফিসার সত্যেন কুমার বলেন, ‘আমরা নাচোল উপজেলায় বিগত বছরগুলোতে অনেক কৃষককে কেঁচো এবং চারি দিয়েছি, কিন্তু কোন কৃষকই সফলতা আনতে পারেনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘মূলত রুক্ষ আবহাওয়া এবং অধিক গরমের কারণে কেঁচো মরে যাবার কারণে এমনটি হয়েছে। কৃষক রায়হান কবির রঞ্জু নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে ভার্মি কওেম্পাস্ট সার (কেঁচো কম্পোস্ট সার) উৎপাদনে সফলতা এনেছেন। আমরা এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উপজেলায় ভার্মি কম্পোস্ট সারের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছি।’
কৃষক রায়হান কবির রঞ্জু বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে ভার্মি কম্পোস্ট সার কৃষকদের মধ্যে ব্যবহারের দিকটা একেবারেই অজানা থাকায় সার বিক্রি হতো না। কৃষকদের মধ্যে সচেতনতাও কম ছিলো।’ তার মতে, দিনে দিনে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহার ও উৎপাদন বাড়ছে এই এলাকায়।