জৌলুস হারাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যের “নৌকা বাইচ”

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) থেকে

আল্লাহ রাসুলের নাম লইয়্যা নাও খোলরে,
সোনার নায়ে পবনের বইঠ্যা ধরোরে,
হিয়াব্বোল-হিয়াব্বোল”

 

প্রমত্তা নদীবক্ষে সমবেত কণ্ঠে সারিগানের তাল-লয়ে মাঝি-মাল্লাদের বৈঠার ছন্দময় প্রতিযোগিতা। শিশু-কিশোর থেকে বৃদ্ধ, হাজার হাজার মানুষের আবেগ-উত্তেজনার মূহুমূহু কলধ্বনী। সে এক মনোমুগ্ধকর নির্মল আনন্দের খোরাক। নদী তাই হয়ে উঠেছে মানিকগঞ্জের মানুষের আশৈশব প্রাণোচ্ছল ক্রীড়াসঙ্গী। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা বাইচ প্রচলিত আছে স্মরণাতীতকাল থেকে। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় নদ-নদীর উপস্থিতি প্রবল এবং নৌকা বাইচ এদেশের লোকালয় ও সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ফসল। নদীবেষ্টিত মানিকগঞ্জে নৌকা বাইচ জেলার মানুষজনের মাঝে যোগ করে এক ভিন্ন আনন্দমাত্রা।

হাজার বছরের ঐতিহ্য নৌকা বাইচ। বর্তমানে চলছে অনেকটাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অথচ এক সময় নৌকাবাইচ ছিল নদী পাড়ের মানুষের প্রধান উৎসব। প্রতিবছর ভাদ্রে এ উৎসব পালিত হতো। তবে এখন সেটা আর নেই। আষাঢ়-শ্রাবণে বর্ষাকাল নেই বলেই নৌকাবাইচ আর চলে না। ফলে নৌকাবাইচের ঐতিহ্য আর জৌলুস এখন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

1 (1) (1)

পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, কান্তাবতী বিধৌত মানিকগঞ্জের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আনন্দ আয়োজন, উৎসব ও খেলাধুলা সবকিছুতেই নদী ও নৌকার সরব আনাগোনা। নৌকা বাইচ আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির একটি অংশ। বর্তমান যান্ত্রিক যুগে এসে বাঙালির প্রাচীন এই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। ভাদ্র মাস আসার আগেই নদীপারের মানুষ প্রস্তুতি নেয় বাইচ উৎসবের। চলে নৌকার ঘষামাঝা। সবার বাড়িতে চলে উৎসবের আয়োজন।

গণবিনোদন হিসেবে নৌকাবাইচের প্রচলন হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত মারফত জানা যায়, পৃথিবীতে সর্ব প্রথম ‘মেসোপটেমিয়ার’ লোকেরাই এই খেলাটির প্রচলন করেছিল বলে ইতিহাস বলে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২০০০ বছর আগে ‘মেসোপটেমিয়ার’ লোকেরা ইউফ্রেটিস নদীতে একধরনের নৌকাবাইচের আয়োজন করত। এর কয়েক শতাব্দী পর মিসরের নীল নদের জলে নৌকা চালনা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এরপর ছড়িয়ে পড়তে থাকে এর প্রসার। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতাটি এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়। ১৯০০ সাল থেকে অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় নৌকাবাইচ অন্তর্ভুক্ত আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সংস্কৃতি এখন চালু রয়েছে।

1 (2) (1)

এদিকে, প্রায় ২০০ বছর ধরে মানিকগঞ্জে কলতা এলাকায় কান্তাবতী নদীতে, নবাবগঞ্জের ইছামতি নদীতে নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এছাড়াও কালীগঙ্গা নদীর বালিরটেক ও বেউথায়, যমুনা নদীর আরিচায়, দৌলতপুরে এবং কালের সাক্ষী হিসেবে সিংগাইরের পারিলের নৌকা বাইচ দীর্ঘদিন যাবত নৌকাবাইচ মানুষের বিনোদন দিয়ে আসছে। তাই এসব এলাকায় ছোট বড় সবার কাছে নৌকাবাইচ সমান গ্রহণযোগ্য একটি উৎসব। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের ১ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত নৌকাবাইচ হয়ে থাকে বিভিন্ন স্থানে। ভাদ্র মাস আসার আগেই নদীপাড়ের মানুষ প্রস্তুতি নেয় নৌকাবাইচ উৎসবের। চলে নৌকার ঘষামাজা। সবার বাড়িতে চলে উৎসবের আয়োজন। বাড়ির বধূরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন নৌকাবাইচ দেখতে আসা আত্মীয়দের জন্য পিঠাপুলি বানাতে।

নৌকাবাইচ সমন্ধে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মাঝে জনশ্রুতি আছে, জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার সময় স্নানার্থীদের নিয়ে বহু নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লা-যাত্রীরা প্রতিযোগিতার আনন্দ পায়। এ থেকে কালক্রমে নৌকাবাইচের শুরু। অন্য একটি জনশ্রুতি হলো, পীরগাজীকে কেন্দ্র করে। আঠার শতকের শুরুর দিকে কোনো এক গাজী পীর মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড়ে থাকা তা ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন। কিন্তু ঘাটে কোনো নৌকা ছিল না। ভক্তরা তার কাছে আসতে একটি ডিঙি নৌকা খুঁজে বের করেন। যখন নৌকাটি মাঝ নদীতে এলো, তখনই নদীতে তোলপাড় আরম্ভ হলো। নদী ফুলে ফেঁপে উঠল। তখন চারপাশের যত নৌকা ছিল, তারা খবর পেয়ে ছুটে আসে। সারি সারি অজস্র নৌকা একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে। এ থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়। আবার অনেকের মতেই, মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের আমলে নৌকাবাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। নবাব বাদশাহদের নৌবাহিনী থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়।

1 (3) (1)

নৌকার মধ্যে ঢোল, তবলা, টিকারা নিয়ে গায়েনরা থাকেন। তাঁদের গানগুলো মাঝিদের উৎসাহ আর শক্তি জোগায়। ঢোল ও করতালের, টিকারা, কাঁসির সঙ্গে সঙ্গে নৌকাবাইচে মাঝি-মাল্লারা তালে তালে একসুরে গান গেয়ে ছুটে চলেন। যার ফলে কোনো বৈঠা ঠোকাঠুকি না লেগে একসঙ্গে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। গায়েন বা পরিচালক কাঁসির শব্দে এই বৈঠার এবং গানের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলে নিজেদের নৌকাকে সবার আগে যাওয়ার চেষ্টায় প্রয়োজনবোধে কাঁসির শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে গানের গতিও বেড়ে চলে।

বাইচের নৌকা হয় সরু ও লম্বাটে। কারণ, সরু ও লম্বাটে নৌকা নদীর পানি কেটে দ্রুতগতিতে চলতে সক্ষম। বিভিন্ন আকৃতির নৌকা সমবেত হয় বাইচ প্রতিযোগিতায়। ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, পাতাম, বাচারি, রপ্তানি, ঘাসি, সাম্পান ইত্যাদী নৌকা বাইচে অংশ নেয়। একেকটি লম্বায় প্রায় ১০০ থেকে ২০০ ফুট হয়। নৌকার সামনে সুন্দর করে সাজানো হয় এবং ময়ুরের মুখ, রাজহাঁসের মুখ বা অন্য পাখির মুখের অবয়ব তৈরি করা হয়। দর্শকদের সামনে দৃষ্টিগোচর করতে নৌকাটিকে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করা হয়। গায়না তরী, সোনার চান, মায়ের দোয়া, হারানো মানিক, দুই ভাই, সোনার বাংলা, রিয়াদ এন্টারপ্রাইজ, হাজারী তরী, আল্লাহর দান, শোকচাঁন তরী, অগ্রদূত, ঝড়ের পাখি, পঙ্খীরাজ, ময়ূরপঙ্খী, সাইমুন, তুফানমেইল, জয়নগর, চিলেকাটা, সোনার তরী, দীপরাজ ইত্যাদি নামকরণ করা হয়।

বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার কলতা কান্তাবতি নদীতে দুই’শ বছরের ঐতিহ্য নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঈদের আনন্দের সাথে বাড়তি আনন্দ দিতে হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা ইছামতি নদীতে এলাকার জামাই ও চাকুরীজীবীদের সৌজন্যে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ। এছাড়া মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার চকমিরপুর ইউনিয়নের সমেতপুর আদর্শ গ্রামের উদ্যোগে সমেতপুর বিলে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে কমপক্ষে অর্ধশত নৌকা অংশগ্রহণ করে। মানিকগঞ্জ শহরের ঐতিহ্যবাহী কালিগঙ্গা নদীতে এই নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বালিরটেক কালিগঙ্গা নদীতে অনুষ্ঠিত হয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা।

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ভাড়ারিয়া, হাটিপাড়া ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী এলাবাসির যৌথ উদ্যোগে গত ৫ সেপ্টেম্বর এ নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয়। রঙ বেরঙের বাহারি ধরনের নৌকায় বালিরটেকের কালিগঙ্গা নদী হয়ে উৎসব মুখর হয়ে উঠে। মানিকগঞ্জের ঝিটকায় ইছামতি নদীতে ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ দেখতে হাজারো মানুষের উপচেপড়া ভীড় পরিলক্ষিত হয়। শিবালয় উপজেলার আরুয়া ইউনিয়নের দড়িকান্দি-নয়াকান্দি ইছামতি নদীতে স্থানীয় এলাকবাসীর উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। হরিরামপুর উপজেলার সাপাই দিয়াবাড়ীবিল, দৌলতপুর উপজেলায় সমেদপুর গ্রামে ইছামতি নদীতে, সিংগাইর উপজেলায় চান্দহরে ধলেশ্বরী, বলধারা রামকান্তপুর এবং ঘিওর উপজেলায় পেঁচারকান্দা-কুশুন্ডা-জাবরা এলাকায় ইছামতি নদীতে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাইচ দেখতে গ্রামকে গ্রাম, পাড়া মহল্লা নাচিয়ে দুরদুরান্ত এলাকার হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে নদীর দু’পাড়ে।

ঘিওর উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামের বাইচের নৌকার জনপ্রিয় মাল্লা মুন্নাফ মোল্লা বলেন, “নৌকায় ওঠার ক্ষেত্রে রয়েছে নানান আনুষ্ঠানিকতা। সকলে পাক-পবিত্র হয়ে গেঞ্জি গায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল বেঁধে নেয়। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক। প্রতিটি নৌকায় ৫০ থেকে ১০০ জন মাঝি থাকে। যে কেউই নৌকার মাঝি হতে পারবে না। মাঝি হতে হলে তাকে একটু হৃষ্টপুষ্ট হতে হয়। ছয় মাস আগ থেকেই বাছাই করা হতো মাঝিদের। নৌকা তৈরিতে শাল, শীল কড়ই, চাম্বুল, গর্জন ইত্যাদি কাঠ ব্যবহার করা হয়।”

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রোয়িং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, ‘নৌকাবাইচ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য ফেডারেশন বছরে একবার জাতীয় নৌকাবাইচের আয়োজন করে থাকে। তবে এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য দেশের প্রতিটি উপজেলায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একটি নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা থাকা উচিৎ। আর এ প্রতিযোগিতাকে ঘিরে প্রতিবছরই জমে উঠবে উৎসব। যে উৎসবে প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যাবে।’

1 (5) (1)

দেশের জনপ্রিয় ও বৃহৎ বাইচের নৌকা “সোনার বাংলা”র মালিক ডা. শাহীন বলেন, ‘একটি নৌকাবাইচে অংশগ্রহণের জন্য প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। আর প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমরা নামমাত্র পুরস্কার পাই। তারপরও প্রতি বছর নৌকাবাইচে আসি আনন্দের জন্য।’

আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য নৌকাবাইচ নানা প্রতিকূলতার পথ পাড়ি দিয়ে আজ ক্লান্ত। হারিয়ে যেতে বসেছে মেহনতী মানুষের শ্রম, ঘাম, উৎসাহ-উদ্দীপনা, আনন্দ আর উত্তেজনার খেলা নৌকাবাইচ। উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন নৌকার মালিকরা। এখনো বিভিন্ন এলাকায় মাঝেমধ্যে নৌকাবাইচ হয়। কিন্তু আগের মতো সেই আনন্দ-উদ্দীপনা আর আবেদন নেই। যেসব মানুষ এগিয়ে এলে এসব সমস্যা কাটিয়ে, বাইচের নৌকা জল কেটে চলে যাবে সবার আগে। তারা কি এগিয়ে আসবেন না? লোক ঐতিহ্যে অবগাহনে আগামী প্রজন্ম বাঙালি চেতনায় গড়ে উঠবে মন ও মননে, শিক্ষা-দীক্ষায়, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে- এই তো কালের দাবি।

happy wheels 2

Comments