ও নদীরে.. একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
পানি আমাদের অমূল্য সম্পদ, কারণ পানি আমাদের জীবন বাঁচায়। প্রতিদিনের অসংখ্য কাজে আমরা পানি ব্যবহার করি। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত অধিকাংশ কাজেই পানির প্রয়োজন হয়। রান্না করা, খাওয়া, গোসল, ধোয়ামুছা প্রভৃতি কাজ পানি ছাড়া অসম্ভব। পানি ব্যবহারের বড় একটি অংশজুড়ে আছে আমাদের কৃষিকাজ। ফসলের জমিতে পানি সেচ না দিলে সঠিক সময়ে ও পরিমাণে ফসল উৎপাদন হয়না।
বর্তমান সময়ে আমরা আমাদের নিজেদের স্বার্থে ও অসচেতনতায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোকে ধ্বংস করে ফেলছি। ভূগর্ভস্থ পানির অধিক উত্তোলন, নদী দূষণ ইত্যাদি। আবার যে পানি যা আমরা নিত্য কাজে ব্যবহার করি সেটিরও অপচয় করে চলেছি সমানতালে। অধিক ফসল উৎপাদনের আশায় জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য সেলো মেশিন, ডিপ মেশিন ইত্যাদি স্থাপন করছি।
আবার নদীতে বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপ করে পানি দূষণ করছি। ফলে পরিবেশ হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর, পানি হচ্ছে ব্যবহার অনুপযোগি। পানি দূষণের বড় একটি উদাহরণ হচ্ছে আমাদের মগড়া নদী। নেত্রকোনা শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নদীতে শুষ্ক মৌসুমে অল্প পরিমাণ পানি থাকা স্বত্ত্বেও তা ব্যবহার করা যাচ্ছেনা। বাসাবাড়ি, হোটেল রেঁস্তোরা ও হাসপাতালের বর্জ্য পদার্থের ভাগাড় বানিয়ে ফেলছি আমরা এই নদীকে। যে নদীর পাড়ের মুক্ত হাওয়ায় হাঁটা চলা করলে শরীর সুস্থ্য থাকে, অথচ সেই নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হয় নাকে কাপড় চাপা দিয়ে।
তাছাড়া এই নদীর পানি ব্যবহার করে পানির সুবিধা বঞ্চিত অসংখ্য পরিবার তাদের প্রয়োজন মেটায়, সেটা কেউ মাথায় রাখিনা। পানির অভাবগ্রস্ত পরিবারগুলো নদীর ময়লা অংশেই গোসল করে, কাপড় ধোয়। যে পানি জীবন বাঁচায় স্থান, কাল, পাত্র ভেদে সেই পানি জীবন নাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ময়লা ও আবর্জনাযুক্ত পানি ব্যবহারে মানুষ অনেক ধরণের অসুখে আক্রান্ত হয়।
তবে শহর থেকে গ্রামে বয়ে চলা মগড়া নদীর চিত্র কিছুটা ভিন্ন। নদীতে ময়লা ফেলা তো দূরের কথা, বরং পানি শূন্য এই নদীকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছেন। শুষ্ক মৌসুমে নদী পানি শূন্য হলেও নদী তীরে বসবাসরত জনগোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনে শুকিয়ে যাওয়া নদীর অংশ অথবা নদীর মধ্যবর্তী অংশটিকেই সুষ্ঠু ব্যবহার করছেন। চরের অংশে বিভিন্ন মৌসুমী ফসল যেমন মিষ্টি আলু, সরিষা, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি চাষ করছেন। এ সময়ে নদী শুকিয়ে গেলেও মধ্যবর্তী অংশে কিছু পরিমাণ পানি থেকে যায়। সেই অংশে কৃষকগণ ধান চাষও করেন।
তাছাড়া নদীর কুঁড় অর্থাৎ বাঁকের অংশে অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি পানি থাকে। সেই পানি ব্যবহার করে নদী গ্রামের মানুষ নিজেদের নিত্য প্রয়োজনীয় সকল কাজ সারতে পারেন অনায়াসেই। কারণ শুষ্ক মৌসুমে শুধু নদী নয় গ্রামের অগভীর পুকুরগুলোও পানি শূন্য হয়ে যায়। আবার বিভিন্ন ডোবা নালাতেও পানি থাকেনা। টিউবওয়েল থেকেও পানি উঠতে চায়না। এ সময় সবচে’ সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়েন নারীরা। তাঁরা দূর-দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। আর নদীর কুঁড়ে সংরক্ষিত পানি ব্যবহার করে প্রতিদিনের পানির অভাব পূরণ করেন।
শহরে বসবাসরত মানুষেরা গ্রামকে অবহেলা করে। অথচ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নদী দূষণের জন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়। বরঞ্চ তারা নদীর পরিবর্তিত রূপের সাথে খাপ খাইয়ে নদীকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করছেন।
বর্ষাকালে যে নদী বা পুকুর পানিতে থই থই করে, শুষ্ক মৌসুমে দেখা যায় তার ভিন্নরূপ। যে মানুষেরা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা হয়ে যান কর্মহীন। বর্ষায় যে নদীর বুকে নৌকা ভেসে যায়, ট্রলার দিয়ে মালামাল পরিবহন করা হয়, এ সময়ে সে নদী থাকে নিষ্প্রাণ। নৌকা চলা তো দূরের কথা হেঁটেই তখন এপার ওপাড় করা যায়। বর্ষায় নদীতে পানি থাকে বলে নদী পথে বালি, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি পরিবহণের সময় বেছে নেয়া হয় বর্ষাকালে। এ সমকার নদীর প্রমত্তা রূপ দেখে কত শিল্পী, সাহিত্যিকগণ কাব্য, গান রচনা করেছেন। নদীর ঢেউয়ের সাথে নিজের দুঃখগুলোকে ভাসিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু দূষিত আর শুষ্ক নদী অন্যের দুঃখ বহন করবে কি, সে তো নিজেই কাঙাল।
জানা যায় ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে মগড়া নদীতে জাহাজ চলাচল করতো। সময়ের বিবর্তনে এই নদীটি এখন নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায়। মালবাহী জাহাজ আর কখনোই এর বুকে ভেসে বেড়াবেনা। এক দিকে মৃত নদী অন্যদিকে দূষণ। এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে মগড়া নদী নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। শহরে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থান নেই বলে সবাই নদীর পাড় বেছে নেয়। বর্ষাকালে নদীতে পানি থাকে বলে আবর্জনাগুলো ভেসে চলে যায়, এক জায়গায় স্থির থাকেনা। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে এই সুবিধা নেই। যে কারণে এক দিকে নদীর পানি শূন্যতা অন্যদিকে ময়লা আবর্জনার স্তুপের কারণে নদীর সীমানাও বোঝা যায়না।
জীবন ধারণের জন্য সুস্থ, সুন্দর পরিবেশ আমরা সবাই কামনা করি। কিন্তু তৈরি করিনা। যে পরিবেশে আমার সন্তান বেড়ে উঠছে, সে পরিবেশ থেকে সে কতটুকু শিক্ষা পাবে? সে পড়ছে বইয়ের পাতায় নদী বলতে অথৈ পানি, অথচ চোখের সামনে দেখছে নদী বলতে ময়লার স্তুপ। যখন খুশি, যেভাবে খুশি কোট-প্যান্ট পড়া সাহেব সেজে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে ময়লার থলে নদীতে নিক্ষেপ করা যায়। নদীর বুকে নৌকা চলে। কিন্তু আমাদের নদীতে রবি ঠাকুরের নদীর মতো হাঁটু পানিও থাকেনা আবার ক্রিকেট খেলা যায়।
হায়রে প্রকৃতি! এখন শুধুই বইয়ের পাতায়, ছোট্ট শিশুর ড্রইং করা কাগজে। চোখের সামনে যা আছে তা দেখে আর কোমলমতি শিশুদের প্রকৃতি শেখানো যাবেনা। আমরা জাতি হিসেবে উন্নত হচ্ছি কিন্তু বাদ দিয়েছি আমাদের ঐতিহ্য, সভ্যতা আর প্রকৃতি। প্রকৃতিকে প্রাকৃত রাখতে হলে নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে নদীকে কোনো কথা শুধানোর আগে সে যদি আমাদের প্রশ্ন করে আমাকে নষ্ট করেছ কেনো? তার উত্তর আমাদের জানা আছে কি?