শিক্ষকের উদারতায় পিতৃহারা দরিদ্র শিক্ষার্থী লেখা পড়ার সুযোগ পেয়েছে
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
একজন পিতা হলো সন্তানের বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমাদের সমাজে যেহেতু পুরুষকেই পরিবারের প্রধান হিসেবে গণ্য করা হয়, সেহেতু পুরো পরিবারের খরচ মেটানোসহ সিদ্ধান্ত দেবার একমাত্র কর্ণধার হলো পিতা। তাঁর ভরসায় সন্তানরা বেড়ে উঠে, ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে। কারণ সিদ্ধান্ত প্রদানের পাশাপাশি অর্থের যোগানদারও তিনি। শিশু যখন বড় হতে থাকে তখন বাইরের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন একজন পিতা। তাঁর হাত ধরেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে শেখে একজন সন্তান।
কিন্তু মোস্তাকিম এর বেলায় এমনটি হয়নি। যে সময়ে একজন শিশুর ভরসার স্থান হলো তার বাবা, সে বয়সেই তাকে পিতৃহারা হতে হলো। কেউ সারাজীবন বেঁচে থাকেনা সত্যি কিন্তু আরো একটু সময় তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো সন্তানদের জীবনে চলার পথটা তৈরি করে দিতে পারতেন।
লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের দরুন হাসামপুর গ্রামের এক কিশোর মো. মোস্তাকিম। আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে তার বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন। তখন সে মাত্র পাঁচ বছরের। কোনো কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। বাবার কথা খুব বেশি মনে করতে পারেনা সে। ছোট ভাইয়ের বয়স ছিল তখন দুই বছর।
এরপর থেকে তারা দুই ভাই মায়ের তদারকিতেই বড় হচ্ছে। বাবার রেখে যাওয়া একটি মাত্র বসত ঘর ছাড়া কিছুই নেই। কারণ মোস্তাকিম এর বাবা সামান্য একজন কৃষক ছিলেন। ধানের জমি যতটুকু ছিল তার চাচারা দখল করে নেয়। সন্তানদের খাওয়ার খরচ যোগাড় করতে গিয়ে মোস্তাকিমের মা অন্যের বাড়িতে কাজ নেয়। তাছাড়া শুধু খাবার যোগাড় করলেই তো হবেনা। ছেলেরা আস্তে আস্তে বড় হবে, চাহিদা বাড়বে। পড়ালেখা করতে হবে। আবার স্বামীর চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা ধার করতে হয়েছিল। তাও শোধ করতে হবে। এসব ভেবেই অন্যের বাড়িতে কাজ নেয়া।
এভাবেই দিন কাটাচ্ছিলেন। সময়ের বিবর্তনে সময় তো যাবেই। আটকে রাখা যাবেনা। তাই মোস্তাকিমে স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় হলো। পার্শ্ববর্তী গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করা হয়। এখানে তেমন খরচ লাগেনা। শুধু খাতা, কলম কিনে দিলেই হয়। কোনোদিন খেয়ে না খেয়ে বা এক বেলা করে খেয়ে দিন যেতে লাগলো।
পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষায় ভালোভাবে সে উত্তীর্ণ হলো। এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হবার পালা। গাছের সুপারি বিক্রি করে মা রুবিনা আক্তার ছেলেকে লক্ষ্মীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু সমস্যার বিষয় হচ্ছে মাসিক বেতন। সংসারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব নাজুক। যেখানে খাওয়া জোটেনা ঠিকমতো সেখানে ছেলের বেতন দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। কিন্তু পড়ালেখাও বাদ দিতে পারবেনা। কারণ ছেলের পড়ার প্রতি খুব আগ্রহ। আজ বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এসব নিয়ে চিন্তা করতে হতোনা। মায়ের অসহায় অবস্থা দেখে ছেলের মনেও শঙ্কা। পড়া লেখা যদি বন্ধ হয়ে যায়। ধার দেনা করে তো আর সব সময় পড়ার খরচ চালানো যাবেনা।
বারসিক’র কার্যক্রম ভিন্ন ধর্মী হওয়ায় কর্মএলাকার জনগোষ্ঠী এর কর্মকর্তাদের তাঁদের নিজ পরিবারের সদস্যই মনে করে। যে কারণে নির্দিষ্ট আলোচনার বাইরেও নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে থাকেন। ছেলের পড়া লেখা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে রুবিনা আক্তার বারসিক কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করেন।
সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে বারসিক’র পক্ষ থেকে লক্ষ্মীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সাথে মোস্তাকিমের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রধান শিক্ষক তাঁর প্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী মোস্তাকিমের সারা বছরের বেতন মওকুফ করে দেন। শুধু তাই নয় দশম শ্রেণি পর্যন্ত তার কোনো বেতন দিতে হবে না বলে বারসিক কর্মকর্তাকে আশ্বস্ত করেন। এবং শিক্ষার্থীর পরিবারে এই খবর পৌঁছে দিতে অনুরোধ করেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বার্তাটি মোস্তাকিমের মাকে জানানো হলে তিনি অনেক খুশি হন এবং শিক্ষকসহ বারসিক কর্মকর্তার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, নেত্রকোণা কর্ম এলাকার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বারসিক’র বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। যে কারণে প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে বারসিক’র খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শুধু বারসিক পরিচালিত কার্যক্রম নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আয়োজনেও বারসিক কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
শিক্ষক হলেন সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর। তাঁরা সবসময় একজন শিক্ষার্থীর জীবন গড়ে দিতে সহযোগিতা করেন। এমনই একজন শিক্ষক হলেন ল²ীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ.টি.এম এখলাছুর রহমান। তাঁর উদারতায় একজন দরিদ্র শিক্ষার্থী পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছে।