শত জীবনের স্বাক্ষী ‘আয়েশা ডাক্তার’
পাভেল পার্থ
‘আপা খাড়াইন, খাড়াইন। আমরার আবুর (শিশু) কাশ (কাশি) হইছে, একটু দেইখ্যা গাছন্ত (ভেষজ) ওষুধ দিয়া যাইন’। গণগণে রোদের ভেতর চারধারে হাওরের শুকিয়ে যাওয়া জলের ভেতর ছোট্ট এক রাস্তায় ঘেমে নেয়ে থামেন ‘আয়েশা ডাক্তার’।
অপেক্ষমাণ নারীদের সাথে হেঁটে হেঁটে তাদের ঘরে পৌঁছান। গ্রামের গরিব কৃষকের ছোট্ট ঘর। কালো রঙের ডাক্তারি ব্যাগ থেকে স্টেথোস্কোপ বের করে বাচ্চার বুকে লাগিয়ে পরীক্ষা করেন এবং থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করেন। শিশুদের দেখে গাছন্ত ওষুধ দেন। সকাল ও বিকালে কালো তুলসী পাতা, আদা, বাসক পাতার রস হালকা গরম করে অল্প মধু মিশিয়ে খেতে বলেন। বাড়িরে নারীদের দেয়া পান একটুকরো ছিঁড়ে কোনোমতে মুখে গুঁজে আবার রওনা দেন। এভাবেই সকাল থেকে রাত অবধি যেন তার কোনো থামা নেই। আজ এর বাড়িতে প্রসব, কার ঐ বাড়িতে ছ্টো বাচ্চার পাতলা-হাগা, জটিল প্রসব বেদনায় কাতর গরিব মাকে হাসপাতালে নেয়ার কেউ নেই, হাসপাতাল যাদের থেকে দূর বহুদূর তাদের কাছে রাতবিরেতে ছুটে যান ‘আয়েশা ডাক্তার’। এভাবেই দীর্ঘ পনের বছর ধরে গ্রামীণ নারী ও শিশুদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবায় নিজেকে সঁপে দিয়ে আপনমানুষ হয়ে ওঠেছেন, আয়শা খানম। মুখে মুখে ভালবাসায় হয়ে গেছেন ‘আয়েশা ডাক্তার’। নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিশারা গ্রামের আয়শা খানমের জন্ম এক বাঙালি মুসলিম কৃষক পরিবারে। মা জিলা বানু আর বাবা ফইজুদ্দিন খান। খুব ছোট্টবেলা গ্রামের মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়েছেন, অক্ষর আয়ত্ত করতে পারেননি। কোনোমতে নিজের নামটা লিখতে শিখেছেন। মায়ের কাছ থেকে দেখে দেখে কিছু গৃহস্থালি কবিরাজি আয়ত্ত করেন। পরবর্তীতে নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার চন্দ্রপুরের চন্দ্রপুরী নূরীবাবার কাছ থেকে কিছু দীক্ষা নেন। গ্রামের মুরব্বী কবিরাজদের ও ধাত্রীদের কাছ থেকে নেন চিকিৎসা শিক্ষা। পরিবার ও আশেপাশে প্রাথমিক কবিরাজি দিয়ে তার যাত্রা শুরু। প্রায় দশ বছর হলো তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেছেন একজন সফল গ্রামীণ ধাত্রী হিসেবে। কলমাকান্দার নানান গ্রামে তাঁর বেশ নামডাক, তাঁর হাতে প্রসবের জন্য অনেকেই তাকে আগেভাগেই জানিয়ে রাখেন। এ পর্যন্ত প্রায় একশত শিশুর জন্ম হয়েছে তাঁর হাতে, সবই প্রাকৃতিকভাবে সম্পন্ন প্রসব। কোনো অস্ত্রপচার বা এমনকি হাসপাতাল নয়, প্রত্যন্ত গ্রামে বাড়িতেই সেসব সুসম্পন্ন হয়েছে।
নেত্রকোণার কলমাকান্দার হাওর ও সীমান্তবর্তী জনপদে নেই কোনো হাসপাতাল। নেই কোনো রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাসেবা। এখানে গ্রামীণ কবিরাজি ও ধাত্রীরাই সব। হাজার বছর ধরে গ্রামীণ নারী এ ধাত্রীবিদ্যা বহন করে চলেছেন। স্থানীয়ভাবে বাঙালিরা ধাত্রীদের বলেন দাই, এ অঞ্চলের মান্দি আদিবাসীদের ভাষায় তিনি কামাল মিচিক এবং হাজংরা বলে দইমা। গর্ভসঞ্চার থেকে শুরু করে সন্তান প্রসব সবই তার মুখস্থ। জটিল প্রসব ও যন্ত্রণামুক্ত নিরাপদ প্রসবের জন্য একজন ধাত্রীকে জানাবোঝার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এক কঠিন সাধনা ও শিক্ষাকাল অতিক্রম করতে হয়। আয়শা খানম গ্রামের প্রবীণ নামযশ আছে এমন ধাত্রীদের দেখে দেখে আয়ত্ত করেছেন ধাত্রীবিদ্যার কঠিন কারিগরিগুলো। পাশাপাশি গাছন্ত কবিরাজিও তার চর্চার অন্যমত একটি বিষয়। তিনি কেবল এসব পথ্য নির্দেশাই করেন না, তার বাড়িতে তিনি তৈরি করেছেন ছোট্ট এক ঔষধি বাগান। যেন এক জীবন্ত ঔষধঘর। এখান থেকে গাছের ডাল, বীজ ও কন্দ অনকে দূরদূরান্তের নারীরা নিয়ে যায়। এভাবেই ঔষধি উদ্ভিদের জাত ও বৈচিত্র্য প্রসারেও তার একটি মৌন ভ’মিকা আছে।
আগের দিনে বাঁশের ছিলা দিয়ে নতুন বাচ্চার নাড়ী কাটা হতো। এখন পরিচ্ছন্ন ব্লেড বা কাঁচি ব্যবহৃত হয়। এখন প্রসবে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস দরকার হয়ে পড়েছে। আয়শা খানমের মতো গ্রামের ধাত্রীদের পক্ষে সবসময় এসব কেনা বা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। আয়শা খানম বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক থেকে সেবিকা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং ব্র্যাকের গ্রাশীণ সেবিকা হিসেবে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক যখন নয়দিনব্যাপি ধাত্রী প্রশিক্ষণ কোর্স আয়োজন করে সেখানে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং সফলভাবে সেটি সম্পন্ন করেন। বারসিক আয়শা খানমের মতো গ্রামীণ ধাত্রীদের প্রসব ও প্রাথমিক চিকিৎসাকাজে ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করে। ইতোমধ্যে আয়শা খানম অনেক কিছু আয়ত্ত করে ফেলেছেন। রক্তপরীক্ষা, রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা, রক্তচাপ, শরীরের তাপমাত্রা এবং ওজন পরীক্ষা হরহামেশাই এখন তারা তাদের নিজেদের ব্যাগে রাখা যন্ত্রপাতি দিয়ে সেরে নিচ্ছেন। আরো যেন ডাক বেড়েছে, এ বাড়ি ও বাড়ি করে হাটি ছাড়িয়ে দূরের গ্রাম পর্যন্ত।
আয়শা খানম বারসিকের এ ধাত্রী প্রশিক্ষণ এবং ধাত্রীদের সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়ে বলেনছেন, এভাবে যদি সবাই ভাবতো তবে নারীজাতি আরো উন্নতি করতো পারতো। নারীজাতির ভিতর বুদ্ধি শক্তি সাহস সব আছে, কিন্তু আমরা তারে কদর করি না। আজ আমরাই গ্রামের সাধারন মহিলারাও ডাক্তারি যন্ত্রপাতি দিয়া ভাল কাজ করতে পারতেছি। আমরা গর্ভবতী মায়ের কষ্ট ও অবস্থা আরো ভাল বুঝতে পারতেছি। যদি কঠিন কোনো সমস্যা হয় তবে আগেই আমরা রোগীরে হাসপাতালে নিয়া যাইবার কথা বলতে পারতেছি। গরিব মানুষের আগে তো এইটাও ছিল না, আস্তে আস্তে হয়তো সব হবে। আয়শা খানম প্রমাণ করে চলেছেন সত্যিকারের সহযোগিতা ও স্বীকৃতি পেলে যেকোনো মানুষ তার যোগ্যতা ও পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে সমাজের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রিয়জন হয়ে ওঠতে পারে। হয়ে ওঠতে পারে প্রিয় ‘আয়েশা ডাক্তার’।