আমিও মানুষ তারাও মানুষ, আমিও পারি
কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে অর্পনা ঘাগ্রা:
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গ্রামীণ বিভিন্ন পেশার বিলুপ্তি, গ্রামীণ সংস্কৃতির বিলুপ্তি, নারী পুরুষের সমতার অভাব, সমাজে নারীর অধঃস্তন অবস্থান প্রভৃতি কারণে গ্রামীণ নারীদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ থেকে তারা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হন। কিন্তু গ্রামীণ জনপদে নারীদের জীবন ও জীবিকায়ন প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা ও প্রকৃতিকে ব্যবহার করে, নিজেদের সংগঠন গড়ে তুলে কিছু কিছু ব্যতিক্রমী নারী সংসারের গতানুগতিক কাজের বাইরে বেড়িয়ে এসে নিজের জীবন ও জীবিকায় আনছে নানান পরিবর্তন। এমনই একজন খারনৈ ইউনিয়নের ভাসানকুরা গ্রামের জোনাকী আলো মহিলা সংগঠনের সভানেত্রী পূর্ণিমা হাজং যিনি সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেছেন। তার নিজস্ব উদ্যোগে তিনি ছোট ছোট দল, সমিটি, সংগঠন গঠনের মাধ্যমে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাচ্ছেন যা সামাজিক স্থায়ীত্বশীল পরিবর্তনে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
পুর্ণিমা হাজং বলেন, “আমিও প্রথম প্রথম যখন বিভিন্ন অফিসে যাইতাম তখন কথা বলতে গেলে হাত পা কাঁপতো। কিন্তু পরে ভাবলাম আমিও মানুষ তারাও মানুষ। আমার সাথে তো অফিসাররা ভালো ব্যবহার করেন, তাহলে তাদের সাথে কথা বলতে গেলে আমার কেন হাত পা কাপে? পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মনে সাহস সঞ্চয় করলাম। এখন আমি যেকোন অফিস আাদালতে একাই গিয়ে প্রয়োজনীয় সব কাজ করতে পারি।”
প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় গ্রামের নারীরা কোন অফিসে গিয়ে কথা বলতে লজ্জ্বা পান। অফিসে যাওয়ার কথা বললেই অনেকেই সংসারের অজুহাত দেখান। কোন অফিসে গিয়ে সাহসের সাথে কথা বলা ও সেবাগুলো আদায় করার ক্ষমতা অর্জন করার মধ্যেও যে উন্নয়ন হয় তা তারা ভাবেন না। এই পরিস্থিতি থেকে নারীদের বের করার জন্য এ অঞ্চলে এ ধরনের নানান সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে।
পুুর্ণিমা রাণী জানান, আজ থেকে ৮ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন সন্তানকে নিয়ে দুর্যোগময় সময় অতিবাহিত করেছেন। বাজারে পর্যন্ত যাওয়ার অভ্যাস ছিল না তার। তাই বাজার করা, ঔষধ পত্র ক্রয় করা থেকে শুরু করে সব কাজে অন্যের উপর নির্ভরশীল থাকতে হতো। তার জন্য অনেক কথাও শুনতে হয়েছে। এক সময় তিনি চিন্তা করেন এভাবে বাঁচার কোন মূল্য নাই। মর্যাদার সহিত সমাজে তাকে বাঁচতে হবেই।
এরপর ২০০৮ সালে মাত্র ১৫ জন নারীকে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন জোনাকী আলো মহিলা উন্নয়ন সংগঠন যা ২০১৫ সাথে উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর কর্তৃক রেজিষ্টারভূক্ত হয়। এই সংগঠনের সদস্যরা প্রতি মাসে ১০ টাকা সঞ্চয় করেন। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ২০০ জন। তাদের বর্তমান মূলধন ৪,০০০০০/- (চার লক্ষ) টাকা। সদস্য সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে এখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ১০টি দলে বিভক্ত করা হয়েছে। ১০টি ক্ষুদ্র দলের সভানেত্রীদের নিয়ে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি প্রতি মাসে মিটিং করেন এবং নিজ নিজ দলের কার্যক্রম ও হিসাব সংক্রান্ত তথ্য দেন। তাদের সংগঠন থেকে তারা ছোট ছোট প্রকল্প হাতে নেন। তারা ঋণ দেন মূলত: মৎস্য চাষ, হাঁস মুরগি খামার, গরু ছাগল পালন প্রভৃতি কাজে। তাদের দুই লক্ষ টাকার ১০ কাঠা বন্ধকী জমিও রয়েছে। সেখান থেকে যা আয় হয় তা তারা সঞ্চয় হিসেবে জমা রাখেন।
তিনি জানান, অনেক নারীই নিজেদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছেন এই সংগঠন থেকে ঋণ নিয়ে। বর্তমানে খারনৈ বাজারের কাছে একটি ঘর অফিসের জন্য ভাড়া নিয়েছেন এবং একজন বেতনভূক্ত কর্মীও রেখেছেন। সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে সুন্দরীঘাট গ্রামের ফিরোজা বেগমের। যার স্বামী দিনমজুর, মাথা গোজার ঠাই ছাড়া যাদের কিছুই ছিল না। এই সংগঠন থেকে তাকে বিনা সুদে ১৫০০০/- টাকা ঋণ দেয়া হলে তিনি হাঁসের খামার করেন। ছোট ছোট হাঁসের বাচ্চা ক্রয় করে তা বড় হওয়ার পর ডিম দিলে পর ডিম বিক্রি করে তিনি এই টাকা পরিশোধ করেন। বর্তমানে তার একটি বড় পুকুর আছে। তার এই উৎসাহ দেখে সংগঠন থেকে পুকুরে মাছ চাষের জন্য তাকে পুনরায় ঋণ দেয়া হয়। তিনি এখন বাড়ি তৈরি করেছেন, ফসলী জমি ক্রয় করেছেন। তার স্বামী এখন আর দিনমজুর নয়। একজন সম্মানিত কৃষক।
এভাবে সংগঠনের সদস্যরা কেবল আর্থিক উন্নয়নের কাজই নয় সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজও করে থাকেন। সভানেত্রী পূর্নিমা হাজং এর নেতৃত্বে এই বছর একটি বাল্য বিবাহ বন্ধ, অতি দরিদ্র গর্ভবতী নারীদের মাতৃত্বকালীন ভাতার জন্য কার্ডের ব্যবস্থা করেছেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সেবাসমূহের জন্য সরকারি কৃষি বিভাগ, মৎস্য বিভাগ, যুব উন্নয়ন, সমাজ সেবা অফিসে নিয়মিত যোগাযোগ করেন তিনি একাই। গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিটিতেও তিনি সদস্য হিসেবে আছেন। তিনি শুধুমাত্র হাজং কমিউনিটিতেই না, গারো ও বাঙালি কমিউনিটির লোকজনও তাকে মর্যাদা দেন-সম্মান করেন। তার স্বপ্ন সংগঠনকে শক্তিশালী করা। সেই জন্য সংগঠনের প্রত্যেকটি নারীকে তিনি দক্ষ করে তুলতে চান। তিনি বিশ্বাস করেন সদস্যরা দক্ষ হলেই সংগঠন শক্তিশালী হবে।