প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতা আর কত?
সাতক্ষীরা থেকে শাহীন ইসলাম
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাণী এবং উদ্ভিদগুলো পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। বাঘ হরিণ খায় কিন্ত বাঘের বিচরণের জন্য সুন্দরবনের গাছ রক্ষা পায়। আবার গরু ঘাস, লতা-পাতা ইত্যাদি খায় আবার তাদের মল ফসল বা গাছের বৃদ্ধির জন্য কাজ করে। একটির উপর আর একটি বা একজনের ওপর অন্য একজনের বা পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্কই আন্তঃনির্ভরশীলতা। গাছপালা, পশুপাখি এবং পরিবেশের অন্যান্য উপাদান একে অপরের উপর নির্ভরশীলতা। বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্য এবং আন্তঃনীর্ভরশীলতা কমে যাচ্ছে। বাড়ছে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতা। বৈচিত্র্য এবং আন্তঃনির্ভরশীলতা কমে যাওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। মানুষে মানুষে ¯েœহ-মমতা ও ভালোবাসা হ্রাস পাচ্ছে ফলে সহিংসতা বাড়ছে। শুধু মানুষে মানুষে সহিংসতা নয়, শিল্প বিপ্লবের পর থেকে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতা আজ আমাদের জলবায়ু সংকটে দাঁড় করিয়েছে। তবে, আদিম, সেভেজারি, বারবারিজম যুগের চেয়ে আধুনিক যুগে প্রাণ ও প্রকৃতির সহিংসতা অনেক বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার ঘঁনা ঘটছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার কিছু চিত্র তুলে ধরছি:
বিষ দিয়ে বেগুণ নিধন
সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের সবজি গ্রাম দেওল। গ্রামের প্রতিটি পরিবার কৃষি কাজ করে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই সবজি উৎপাদন করায় এখানকার সবজির চাহিদা বেশি। উৎপাদিত সবজি নকিপুর, নওয়াবেকী, কালিগঞ্জ, নূরনগরসহ জেলার বিভিন্ন বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হয়। গ্রামের কালিপদ মন্ডলের ছেলে পাচুরাম মন্ডল শীত মৌসুমকে ঘিরে বিভিন্ন শাক সবজি চাষের পাশাপাশি ১৫ কাঠা জমিতে কয়েক ধরনের বেগুণ চাষ করে। প্রতিটি গাছে ৪/৫টি করে বেগুণ ধরেছিল। স্বপ্ন দেখেছিলেন বেগুন বিক্রি অনেক অর্থ উপার্জনের। কিন্তু পাচুরামের স্বপ্নের মুখে ছাই ঢেলে দেয় শত্রুপক্ষ। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ঘাস মারা বিষ দিয়ে পাচুরামের এক হাজার বেগুন গাছ মেরে দেয়। ঝলসে যায় সব বেগুন গাছ ও ফল। স্থানীয় ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যান পাচুরামের বেগুন ক্ষেত পরিদর্শন করে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। শ্যামনগরের বিভিন্ন শেণী পেশার মানুষ এ ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে, প্রশাসনের উদ্যোগের অপেক্ষায় পাচুরাম। (ভয়েস অব সাতক্ষীরা,নভেম্বর ১৪, ২০১৬)
অতিথি পাখি বাণিজ্য
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অহরহ চলছে অতিথি পাখি শিকার। আমাদের দেশে প্রকৃতির বন্ধু নানা প্রজাতির পাখি বিভিন্ন দেশ থেকে অতিথি হয়ে আসে। দেশের হাওর, বাঁওড়, নদী-নালা, বিলসহ বিভিন্ন জলাশয়ে বিচরণ করে কিছুদিন। কেননা, শীতকালে সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল তীব্র শীতে আক্রান্ত হয়। তুষারপাত ঘটে। বরফে আচ্ছন্ন থাকে। এ সময় এসব অঞ্চলে পাখিদের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই পাখিগুলো আমাদের মতো নাতিশীতোষ্ণ দেশ কিংবা অঞ্চলে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে উড়ে আসে। এরা আমাদের প্রকৃতির অতিথি। শীত শেষে চলে যায় আপন ঠিকানায়। আর এই সুযোগে কিছু লোভাতুর মানুষ এই পাখিগুলোকে হত্যা করে অর্থাৎ শিকার করে বিক্রয় করে। কিন্তু এই পাখি সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি। এরা প্রকৃতির বন্ধু। এরা প্রকৃতির শোভাবর্ধনকারী। প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে এ বিচিত্র রকমের পাখিগুলোকে বিষ দিয়ে, জাল দিয়ে ও বিভিন্ন কৌশলে শিকার করে কাদাকাটি মৎস্য সেটে এনে বিক্রয় করছেন শিকারীরা। শীতের অতিথি পাখিগুলোকে নির্বিচারে নিধনের কারণে পাখিরা গ্রামবাংলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি না থাকায় বন্য প্রাণী আইন অমান্য করে প্রতিদিন শত শত পাখি নির্বিচারে শিকার করছে পাখি শিকারীরা। এসব পাখি শিকার করে দেদারসে চলছে বনভোজন। অনেক নদী, নালা, খাল, বিলে মাছ দিয়ে ফাঁদ পেতে ও কারেন্ট জালের সাহায্য কৌশলে শত শত অতিথি পাখিগুলোকে ধরে এনে বিভিন্ন দামে বিক্রয় করছেন। এসব পাখিকে রাতে বেশি শিকার করেন শিকারীরা। এছাড়া অনেকে আবার ইয়ারগান (বন্দুক) দ্বারা বিভিন্ন সময়ে পাখি শিকার করে থাকেন। শিকার করা পাখিদের মধ্যে চখাচখি, ডুবরী, জিরিয়া, লেনজা, স্নাইপ, ইটালি, কাইমা, বিভিন্ন জাতের বক ও পানকৌড়ী হাঁসপাখি, বক, বাটাঙ্ক, গরাল, চখাচখি, ৮/৯ ধরনের রাজহাঁস, কুড়াল, কাদিয়াচূড়া, সাল্টি, শামুখ, খোল, হরিকল, হাড়গিলা, শামকাইল, ঘুঘু, শালিক, দোয়েল, মাছরাঙা বেশি চোখে পড়ে। শিকারীরা পাখি নিধন করার কারণে বিভিন্ন রকমের পাখির মিষ্টি মধুর ডাক বা গান এখন কম শোনা যায়। এদিকে পাখি শিকারের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় অনেকেই বহাল তবিয়তে রাত-দিন পাখি শিকার করে যাচ্ছে বলে মনে করেন সচেতন মহল। এসব পাখি ভারসাম্য রক্ষা করে প্রকৃতির। এদের হত্যা করা, শিকার করা অন্যায়। আসুন, এই পাখিদের আমরা রক্ষা করি। তাই এলাকার সচেতন মহাল সংশ্লিষ্ট বিভাগের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন। (তথ্যসূত্র-দৈনিক সাতক্ষীরা, নভেম্বর ১০, ২০১৬)।
কীটনাশকে মাছের প্রাণ হরণ
সাতক্ষীরার কলারোয়ায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে গভীর রাতে শহিদুল ইসলামের ৭০ বিঘা জমির ঘেরে কীটনাশক প্রয়োগ করেছে দুবৃত্তরা। সকালে ঘেরে মাছের খাদ্য দিতে গিয়ে শহিদুল ইসলামের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন দেখে সব মাছ মরে ভেসে উঠেছে। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষরা তার পৌর সদরের মুরারীকাটি বিলে ৩টি ঘেরে বিষ প্রয়োগ করে। এতে তার প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরে খবর পেয়ে কলারোয়া থানার এসআই পিন্টু লাল দাস ও এএসআই রুবেল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ ঘটনায় কলারোয়া থানায় একটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। (তথ্যসূত্র-দৈনিক সাতক্ষীরা)
আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি
কলারোয়া উপজেলায় গভীর রাতে দুর্বৃত্তরা এক কৃষকের গোয়াল ও রান্নাঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। গভীর রাতে উপজেলার সীমান্তবর্তী কেঁড়াগাছি মাঝের পাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, রাত একটার দিকে হঠাৎ তার বাড়ির গোয়াল ঘরে আগুন দেখে তিনি চিৎকার দিয়ে প্রতিবেশীদের ডাক দিলে তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। কিন্তু তার মধ্যেই গোয়ালে থাকা আনুমানিক ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের দু’টি গরু, ৪ হাজার টাকা মূল্যের ১২টি পাতি হাঁস, ১৪টি মুরগি ও ১০ হাজার টাকা মূল্যের ২টি খাসি ছাগল পুড়ে মারা যায়। এ সময় আগুনের লেলিহান শিখায় রান্নাঘরও পুড়ে যায়। (তথ্যসূত্র-দৈনিক পত্রদূত)।
কোটিপতি হতে সুন্দরবনের তক্ষক সাপ চুরি:-
সুন্দরবন থেকে তক্ষক সাপ পাচার করার সময় হাতে নাতে পাচারকারীকে আটক করেছেন বুড়িগোয়ালীনি নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে গড়কুমারপুর খোলপেটুয়া নদীর চরে কেওড়া বন হতে তক্ষক সাপসহ আবুল বাসার গাজীকে আটক করেন। তিনি আশাশুনি থানার নাকনা গ্রামের মৃত্যু আদম গাজীর ছেলে। বুড়িগোয়ালীনি নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সুবেন্দ কুমার জানান, গোপনে জানতে পেরে ঘটনাস্থলে অভিযান চালিয়ে কৌটার ভিতরে রক্ষিত অবস্থায় তক্ষক সাপটিকে উদ্ধার করার পর সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়। এ ঘটনায় বন আইনে ৪১ নং মামলা হয়েছে। (তথ্যসূত্র-দৈনিক পত্রদূত, নভেম্বর, ২৫, ২০১৫)।
উপরোক্ত ঘটনাগুলোর সারমর্ম বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, প্রাণ ও প্রকৃতি মানুষের জীবন বাঁচিয়ে রাখলেও সেই মানুষের সহিংসতায় প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণী। বিষয়গুলো অনেকটা “গাছের মাথায় উঠে গোড়ায় কোপ মারার মত নির্বোধের শামিল”। মানুষ নামের প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য ২৪ ঘণ্টায় অন্য প্রাণ ও প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। গাছ অক্সিজেন বন্ধ করে দিলে মানুষ নামক প্রাণী বাঁচবে না। অথচ সেই মানুষ শত্রুতা, রাগ, ক্ষোভ, লোভ ও লালসায় গাছ কেটে সহিংস আচারণ করছে। আসলে বাঘ হত্যা বীর বা পুরুষত্বের বহিংপ্রকাশ নয়, নির্বোধ কাপুরুষের আস্ফালন। কারণ, বাঘ না থাকলে সুন্দরবন টিকে থাকবে না। আর সুন্দরবন না থাকলে আমাদের বিপন্নতা অনিবার্য। প্রত্যাশা, প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা এবং পরিবেশ আদালতের কার্যকরি ভূমিকা।
পাখি ও মাছের ছবির তথ্যসূত্র দৈনিক সাতক্ষীরা পত্রিকা এবং তক্কসাপ ছবির
তথ্যসূত্র দৈনিক পত্রদূত পত্রিকা