তানোরে রহস্যে ঘেরা বট বৃক্ষ
মিজানুর রহমান, তানোর (রাজশাহী) প্রতিনিধি :
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে/এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ দেখেছিল; জীবনানন্দ দাশ
তাল, তমাল, জারুল, বট, হিজলের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আনাচকানাচে এ গাছগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। এর কোনোটি বয়সে নবীন আবার কোনোটি বহু বছরের, বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজশাহীর তানোর উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে মুন্ডুমালা পৌরসভা এলাকার ময়েনপুর গ্রামে রয়েছে এমনই একটি বটগাছ, যেটির বয়স প্রায় চার শত বছরের ওপরে। গাছটির প্রকৃত বয়স কত, তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও এলাকায় ওই গাছটি ‘রহস্য বট বৃক্ষ’ হিসেবে পরিচিত এবং সমাদৃত। পুরোনো এই গাছ দেখতে বহু দর্শনার্থী ভিড় করেন।
স্থানীয়দের জানান, প্রায় ৪০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে বট গাছটি। শুধু বট গাছ বললে ভুল হবে বট আর পাকুড় বৃক্ষের দৃষ্টিনন্দন যুগলবন্দী এক রহস্য বৃক্ষ। রাস্তার দুই পাশে ছড়িয়ে পড়েছে গাছটির বিশাল শাখা-প্রশাখা। শিকড়-বাকড়ে ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। প্রায় ৪০০ বছরের বট গাছটি আজও রয়েছে তাজা তরুণ আর চিরসবুজ। যেন বার্ধক্যের ছাপ একটুও পড়েনি। আর সে কারণেই এ বট গাছকে ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বট গাছটি ঘিরে নানা রহস্যেঘেরা এসব কাহিনী বংশপরম্পরায় চলে এসেছে। এ গাছের ডালপালা যেমন চারদিকে বিছিয়ে গেছে তেমনি গল্প-কাহিনী আর কল্পগাথাও বছরের পর বছর ধরে ডালপালা গজিয়েছে।
এসব কারণে উপজেলার ময়েনপুর গ্রামের এ যুগলবৃক্ষ দেখতে আসে দূরদূরান্তের অনেক পর্যটকরা। এসব বিবেচনায় দাবি উঠেছে গাছটিকে প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে টিকিয়ে রাখার। এটি একটি মূল্যবান প্রতœসম্পদ হিসেবেও রক্ষণাবেক্ষণের দাবি সচেতন মহলের। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক দুর্লভ তথ্য অনুসন্ধানে গবেষকদের জন্য গাছটি মূল্যবান উপাদান হতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষিতজনেরা।
জানা গেছে, স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়রা গাছটির তলায় বছরে দুইবার ঈদের নামাজ আদায় করে। ঈদের নামাজের পাশাপাশি গাছকে ঘিরে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। সেসব কাহিনী ৪০০ বছর আগে থেকে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
গাছটি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পথিকরা এখানে বিশ্রাম নেয়। আবার দর্শনার্থী আর বৃক্ষপ্রেমিকরা এ গাছ একনজর দেখার জন্য ছুটে আসে। মজার ব্যাপার হলো মায়েরা ছোট বাচ্চাদের এ গাছের গল্প বলতে বলতে ঘুম পাড়ান। ছোটবেলা থেকে এ ধরনের গল্প শুনতে শুনতে তাদের মধ্যে ভয়ভীতিসহ নানা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ গাছ সম্পর্কে অনেকের অনেক রকম ধারণাও জন্মেছে। অনেক ঘটনা আছে।
ময়েনপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক জানান, গাছসংলগ্ন ওই জায়গা সরকারি খাস সম্পত্তির তালিকাভুক্ত। এই বট গাছটি কতশত বছর আগের তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। এমনকি অনেক বয়স্ক মানুষই এই বটগাছের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেনি। শুধু এটাই বলতে পারেন যে তারা এই পৃথিবীর বুকে জম্মানোর পর থেকেই সেই একই রকম দেখে আসছেন বটগাছটি।আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “সবচাইতে অবাক ব্যপার হলো কেউ বলতে পারে না এই বটগাছের উৎপত্তির গোড়া কোথায়, এছাড়াও বাটগাছটি মাঝখানে দেখতে একটি ঘোড়ারমত।”
বটগাছরে নিচে অবস্থিত মনা ঘোষ নামের এক চা দোকানী জানান, তিনি দীঘদিন থেকে বটগাছের নিচে মুদিখানার ব্যবসা করে আসছেন। তিনিও জানেন না এই বটগাছের রহস্য। তবে প্রতিবছরে ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য স্থানীয় লোকজন কিছু এলাকা ঘিরে ওই বটগাছের নিচে ঈদগাহ নির্মাণ করেছেন। বর্তমানে অনেকেই এই বটগাছ দেখার জন্য সেখানে আসেন। তিনি বলেন, “পর্যবেক্ষণের অভাবে বটগাছটির সৌন্দর্য্য হারিয়ে যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্টপোষকতায় সেখানে গড়ে উঠতে পারে বড় ধরনের বিনোদন কেন্দ্র, আর যা থেকে আয় করতে পারবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।” ওই এলাকার বাসিন্দা সামাদ মন্ডল জানান, এ গাছ দেখতে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসেন। তাই এ গাছটির জন্য তাঁরা গর্বিত ও আনন্দিত।
মুন্ডুমালা পৌরসভার মেয়র গোলাম রাব্বানী বলেন, “এ গাছটি আমাদের এলাকার সম্পদ। আমরা চাই বন বিভাগ গাছটির সার্বক্ষণিক দেখভাল করুক, পরিচর্যা করুক, যাতে গাছটি আরও বহু বছর বেঁচে থাকে।’
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মুহা. শওকাত আলী প্রতিবেদককে বলেন, ‘শতবর্ষী গাছ আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। একটি পুরোনো গাছ পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পাখিদের আশ্রয়স্থলও বটে। বড় বড় গাছ রক্ষা করতে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। আর প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই বটগাছ সংরক্ষণে উপজেলা প্রশাসন কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলেও জানান ইউএনও।