সাইদুরের অদম্য পথচলা..
কুমিল্লা থেকে সজীব বণিক
সাইদুর রহমানের জন্ম কুমিল্লার দেবিদ্বার শহরে। তিনি জন্মগতভাবেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। পরিবারের তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সাইদুর রহমান তৃতীয়। তার বাবা মৃত মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লা ছিলেন দেবিদ্বার রিয়াজ উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় তা সত্ত্বেও ছোটবেলা থেকেই সাইদুর রহমান ছিলেন পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী। তিনি সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করে ভর্তি হন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে লোক প্রশাসনের চতুর্থ বছরের ছাত্র সাইদুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই তিনি আবাসিক হলে থাকেন। সেখান থেকেই বন্ধু-বান্ধুবীদের সহযোগিতার মাধ্যমে অটো কিংবা হুইল চেয়ারে বসে ক্লাসে যাতায়াত করেন। শারীরিকভাবে সচল না থাকার কারণে ক্লাস বাদে বাকী সময়টা রুমেই একাকী কাটাতে হয় তাকে। এ সময়ে তিনি বিভিন্ন সাহিত্য পড়েন। তার সাথে ক্লাসের সহপাঠিদের কেমন আচরণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সবাই আমাকে ভাইয়ের মতো দেখে, বিভিন্ন কাজে উৎসাহ দেয় এবং তাদের সাথে এতো দিনের সম্পর্কে আমাকে মনে হয়নি আমি তাদের চেয়ে আলাদা “ সাইদুর বলেন, “আমি আমার স্বপ্ন পূরণে স্বার্থক হলে সমাজ ও তার পারিপার্শ্বিক চিন্তাকেন্দ্রিক অনেক কিছুই পরিবর্তন ঘটাবো। আমরা আজ শুনবো সাইদুর রহমানের স্বপ্ন কাহিনী:
ছোটবেলায় আমার পড়াশোনার প্রতি অনেক ঝোঁক ছিল। শারীরিক প্রতিবন্ধী বলে আমার প্রতি পরিবারের কোনো খারাপ আচরণ ছিল না বরং বিভিন্ন সময়ে তাদের অনুপ্রেরণাই ছিল আমার এগিয়ে যাওয়ার মূল শক্তি। তারপরও বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। আমার বাবার শিক্ষকতা পেশায় যতটাকা পেতেন তা দিয়েই কোনোমতে পাঁচ ভাই-বোনের পড়াশুনার খরচ ও সংসার চালাতেন। বড় বোন ও ভাই দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তেন তখন আমি উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি। বাবা বলতেন, আমার যতোই অর্থকষ্ট হোক আমি পরিবারের কোনো সন্তানকেই পড়াশোনায় ত্রুটি রাখবো না। আমার ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী বলে তাকে পিছিয়ে রাখবো তা হবে না বরং আমাকে সবসময় সাহস জুগিয়েছেন। বাবা-মার স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে আমার ইচ্ছা শক্তিটুকু আরো জাগ্রত করবে। তারপরও অনেকে বাবা-মাকে বলতো, সাইদুরকে পড়াশোনা করিয়ে লাভ কি?
‘শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পড়াশোনার কোনো মূল্য নেই এর চেয়ে বরং নিজেদের কাছেই রেখে দেন, আপনাদের অর্থাকষ্টটা দূর হবে।’ তিনি বলেন, “আমি প্রতিনিয়তই এমন কথা শুনার পর বাবা-মার কালো চেহারার দিকে লক্ষ্য করতাম এবং তাদের মুখ উজ্জ্বল করার জন্যে মনে জিদ তৈরি করতাম। পড়াশোনায় জিদ করেছিলাম, প্রমাণ করবো এদেশে শারীরিক প্রতিবন্ধীরাও ভবিষ্যতে ভালো কিছু করার প্রত্যাশা রাখে।” এতে পড়াশোনার প্রতি আরো বেশি অনুপ্রেরণা দেন বড় বোন আর বাবা।
সাইদুর বলেন, “মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক প্রতিটা পরীক্ষায় আমার ফলাফল তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর বাবা ও বোনের উৎসাহে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি এবং স্বপ্নকে একধাপ এগিয়ে নিতে আল্লাহ’র অশেষ ইচ্ছায় ভর্তির সুযোগ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষে বড় বোন ও ভাইয়ের নতুন চাকুরী আর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সুযোগ পরিবারে একসাথে দুটো সুখবর আমার প্রতি পরিবারের আরো প্রত্যাশা বেড়ে যায়।”
সাইদুর রহমান স্বপ্ন দেখেন, তিনি অনার্স-মাস্টার্স শেষে দেশের বাহিরে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করবেন এবং সেই স্বপ্ন পূরণে তিনি প্রতিনিয়তই প্রচুর পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইংরেজিতে কথা বলা, নিজেকে ডেভেলপ করা এবং ভবিষ্যতে সমাজকে বিভিন্ন সেবা দেওয়ার নানা অভিজ্ঞতা অর্জনের পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পডিয়ামসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজেবল স্টুডেণ্ট এসোসিয়েশনেরও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেহেতু এতোদূর এসেছি,নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করবেন। স্বপ্ন পূরণ হলে সর্বপ্রথম কি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার মতো শারীরিক প্রতিবন্ধী যারা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে, অর্থকষ্ট হচ্ছে তাদের জন্যে একটি আর্থিক ফাণ্ড গঠন করে সহায়তা করবো এবং তারা যেন সম্মান ও মর্যাদার সাথে বসবাস করে নিজেদের মেলে ধরতে পারে সেই বিষয়ে বিভিন্ন কাজ করে যাবো “