ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
বৈচিত্র্যর দেশ বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক কারণেই অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের জীবন, জীবিকার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ছড়িয়ে আছে। এই বৈচিত্র্যর উপর নির্ভর করে বাংলাদেশে প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যেমন ভিন্নতা আছে সেই সাথে অধিকাংশ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত হলেও উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালি মনে ছড়িয়ে থাকা আনন্দের রঙগুলো একসূত্রে গাঁথা।
শীত পেরিয়ে ভিন্ন আমেজে, একেবারে ভিন্ন সাজে আসে বসন্ত। ফাল্গুনের প্রথম দিনে প্রকৃতি যেন এক নতুন সাজে চলে আসে বাঙালির জীবনে। ফাল্গুনের প্রথম সূর্যে আলোয় নেত্রকোনা সদর উপজেলা সাহিত্য সমাজের আহবানে জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর সকল বয়সের মানুষেরা ছুটে আসে নেত্রকোনা জেলা প্রাণ কেন্দ্রে মোক্তার পাড়ায় বকুল তলায়।
প্রায় ২৩ বছর ধরে নেত্রকোনা পালিত হচ্ছে খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরষ্কার অনুষ্ঠানটি। হলূদ লাল শাড়ি, রঙিন পাঞ্জাবী পড়ে নেত্রকোনা সদরের প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষে ভোর থেকে জড়ো হয় বকুল তলায়। এই উৎসবে প্রথমবারের মত যুক্ত হয় নেত্রকোনার মইনপুর গ্রামের ধলাই পাড়ের কিশোরী সংগঠনের কিশোরীরা। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে একটি সাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের জন্য নতুন প্রজন্মকে সকল অসামাজিক কাজ থেকে দুরে থেকে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টিতে বারসিকের উদ্যোগে কিশোরী সংগঠনটি বসন্ত উৎসবে অংশ নেয়।
২৩ বছর ধরে যার নামে এ বকুল তলায় এ বসন্তবর অনুষ্ঠানটি পালিত হচ্ছে তিনি খালেকদাদ চৌধুরী। তিনি একাধারে ছিলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, অনুবাদক। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘শতাব্দীর দুই দিগন্ত’।
ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হয়েও ইংরেজি ১৯০২ সালে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার নাজিরগঞ্জ স্কুলে প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষকতা করতেন। সাধারণ মানুষের কাজে তিনি মাস্টার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
গুণী এ সাহিত্যিকে জীবন আমাদের সমাজ থেকে ধনী, দরিদ্রের ভেদাভেদ ভুলে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ এ মন্ত্রে সকলকে এক ছাতার নিচে দাঁড় করিয়ে দেয়। তার স্মরণে যারা এ পর্যন্ত খালেকদাদ চৌধুরী পুরষ্কার পেয়েছেন-যতীন সরকার, কবি রফিক আজাদ, ড. হুমায়ুন আহম্মেদ, অধ্যাপক কবির চৌধুরী, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি মহাদেব সাহা, সেলিম আল দীন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, রাবেয়া খাতুন, কবি হেলাল হাফিজ, বুলবন ওসমান, আবু হাসান শাহরিয়ার, আনিসুল হক, আলতাব হোসেন, নাসরীন জাহান, রাহাত খান, কবি নূরুল হক, সেলিনা হোসেন, মোহাম্মদ রফিক, জাকির তালুকদার, আসাদ চৌধুরী, খালেদ মতিন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলা, এ বছর-রফিকউল্লাহ খান, কবি মারুফুল ইসলাম।
প্রতিবছরের মতো এ বছরও বসন্ত উৎসবের শুরুতে লাল, নীল, হলুদ রঙের আবিরের তিলক দিয়ে বরণ করা হয় সকলকে। শুরু হয় গানের মাধ্যমে বসন্ত বন্ধনা। এর পর অংশগ্রহনকারী সকলে এক সাথে হাতে হাত রেখে নেত্রকোনা সদরের মূল রাস্তায় চলে র্যালি। দিন ভর কবিতা আবৃতি, শিশুদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, নাচে গানে মেতে থাকে সকলে।
সন্ধ্যায় গুণীজন সম্বর্ধনা এ বছর সাহিত্যে পুরষ্কার পেলেন সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক রফিকউল্লাহ খান, কবি মারুফুল ইসলাম।
বসন্ত মানে প্রকৃতির নতুন সাজ। ঋতুরাজ বসন্তকে স্বাগত জানায় রাঙা পলাশ। শিমুল যেন রাঙা বধূর লাজে রাঙা হয়ে প্রকৃতিকে আরো রঙিন করে তুলে। প্রকৃতি যেন সকল মানুষকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয় সকল উচু নিচুর বিভেদ ভুলে সকল মানুষের রক্তের রঙ লাল।
সকল বয়সের মানুষের মধ্যে যেমন বসন্ত এনে দেয় তারুণ্যের ছোঁয়া তেমনি ভেদাভেদ ভুলে বহুত্ববাদী সমাজ গড়ে তুলায় আহবান যেন বসন্তকালেই শুরু হয়।