শ্যামনগরে আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দাদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিন
শ্যামনগর সাতক্ষীরা থেকে বিশ^জিৎ মন্ডল
ভৌগলিক ও ভূতাত্ত্বিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগপ্রবণ দেশ। জলবাযু পরিবর্তনের ফলে দূর্যোগের প্রকোপ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে এর ক্ষতির মাত্রা ও ক্ষতির পরিধি এবং সাথে বাড়ছে প্রতিনিয়ত জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি। বিগত দশকে দূর্যোগের ঘটনের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ সব ভয়বাহ দূর্যোগের মধ্যে রয়েছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, কালবৈশাখী ঝড়, নদী ভাঙন, খরা, শৈতপ্রবাহ ইত্যাদি। এছাড়া বৈশি^ক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশ নাজুক অবস্থানে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দূর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এতে আমাদের ভূমিকা নগন্য হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক বিরূপ শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। দরিদ্র ও ঘনবসতির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় ও নদী তীরবর্তী এলাকার জনসাধারণের জীবন ও জীবিকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ছে। আশ্রয়হীন এসকল জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে এবং কি করে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা যায় সে সব দিক বিবেচনা করে সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ উদ্যোগের মধ্যে গৃহহীন পরিবারদেরকে আশ্রয়ন করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন ১৯৯৭ সাল থেকে “আশ্রয়ন” নামে।
আমরা জানি যে বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলা অন্যতম। এ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুকিপূর্র্ণ হলো শ্যামনগর উপজেলা। ৩ ফেইজে ধারাবাহিকভাবে এপযর্ন্ত এ উপজেলায় দূর্যোগ ঝুকিপর্র্ণূ কাশিমাড়ি, নুরনগর, বুড়িগোয়ালিনী, আটুলিয়া ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নে মোট ৯টি আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করা হয়। আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরির পর প্রকল্পগুলোতে বসতি কম ছিল। এরপর ২০০৯ সালের সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় আইলায় উপকূলীয় এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়। আইলা পরবর্তী সময়ে আশ্রয়ন প্রকল্পগুলোতে বাস্তুভিটা বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে আশ্রয়ন করা হয়। এখানে আছে হিন্দু, মুসলিম, কাহার, মুন্ডা, জেলে, আদিবাসী, বনজীবী পেশার মানুষ। আশ্রয়ন প্রকল্পগুলোতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তাদের কৃষি উপযোগী পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীরা তাদের জীবন ও জীবিকার মান উন্নয়নে আশ্রয়ন প্রকল্পে বছরব্যাপি সবজি চাষ, বিভিন্ন ফলের গাছ লাগানো, বনায়ন তৈরি, প্রাণী সম্পদ পালন, পুকুরে মাছ চাষসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ ও সেবা আদায়ে সক্ষম হয়ে উঠেছেন। যাতে তাদের নিজেদের অধিকার ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক রাখছে। আশ্রয়ন প্রকল্পগুলো নদীকুলবর্তী হওয়াতে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের কৃষি পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে। তারপরও নিজেদের আপ্রাণ চেষ্টা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মোকাবেলা করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরির সময় তাদের উন্নয়নের জন্য গৃহায়ণ থেকে শুরু করে, রাস্তা ঘাট, পুকুর খনন, বসতভিটা তৈরি, লেট্রিন ও পানির সুব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক ২০১০ সাল থেকে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার মান উন্নয়নে ধারবাহিক সহায়তা করে আসছে এ এলাকায়। বিগত এবং বর্তমান সময়ে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কি ধরনের পরিবর্তন এসেছে সে বিষয়ে বারসিক কর্মকর্তারা ধারবাহিকভাবে পানখালী, বুড়িগোয়ালিনী, কলবাড়ি, সৈয়দালিপুর ও বিড়ালক্ষী আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বলেন। সেক্ষেত্রে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী রোহিতদাস সরদার, মোমিন গাজী, মফিজউদ্দীন ও ফিরোজা বেগমরা বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগের ফলে আমরা পুষ্টি ও খাদ্যে ঘাটতি পূরণে কিছুটা হলেও সফলতা হয়েছি। আশ্রয়ন প্রকল্পে এখন আমরা বিভিন্ন ধরনের সবজি ফল, মাছ খেতে পারছি। নিজেরা প্রাণী সম্পদও পালন করতে পারছি। নিজেদের সমস্যা সমাধানে ভূমিকাও রাখছি। এতে করে আমাদের খাদ্য চাহিদা পূরণ হচ্ছে পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছি। নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত করে কিভাবে তা সমাধান করা যায় সে বিষয়ে আমারা সচেতন।’
আশ্রয়ন প্রকল্পের জনগোষ্ঠীরা আরো বলেন, ‘আশ্রয়ন প্রকল্পগুলো শুরু থেকে এপর্যন্ত এখনো কোনদিন সংস্কার হয়নি। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়াতে অনেক ঘরে ভেঙে পড়েছে, বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি পড়ে, পুকুরের পাড়গুলো ভেঙে ভেঙে ঘরের মধ্যে চলে আসছে, সুপেয় পানির পিএসএফ ও টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়েছে, রাস্তাঘাট চলাচল অনুপোযোগী, ব্যবহার্য ল্যাট্রিনগুলো ব্যবহার যোগ্য নেই, এতে করে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আবার কোন কোন আশ্রয়ন কেন্দ্রের সীমানা নিয়ে পাশ^বর্তী প্রভাবশালীদের সাথে নানান সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেও কোন সুফল হয়নি।’
পানখালী আশ্রয়ন প্রকল্পের সুফিয়া বেগম ও সৈয়দালিপুর আশ্রয়ন প্রকল্পের জ্যোছনা, রাবিয়ারা বলেন, ‘আমরা আশ্রয়ন প্রকল্পে থাকি বলে আমাদের কথা কেউ শোনেনা। সরকারিভাবে ঘর সংস্কারের আশ^াস পেলেও তা কবে হবে তা কেউ জানেনা। অন্য সময়ে যেকোন ভাবে আমরা এখানে থাকতে পারি কিন্তু বর্ষা হলে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর ভোগান্তি বাড়ে। এসময় ঘরের মধ্যে পানি পড়ে, পুকুরের পাড় ভেঙে যায়, সবজি ক্ষেতগুলো নষ্ট হয়ে যায়, বাইরের পানি ঘরের মধ্যে আসে, চলাচলে অসুবিধা, ছেলে মেয়েরা দুরের স্কুলে যেতে পারেনা, ল্যাট্রিনগুলোতে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এসময় রোগ ব্যাধি বেশি হয়। বৃষ্টি সকলের জন্য আর্শীবাদ হলেও আমাদের জন্য তা না।’
তাঁরা সরকারি বেসরকারি সকলের কাছে আবেদন করেন যাতে করে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এবং সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করা এ আশ্রয়ন প্রকল্পগুলো টিকেয়ে রাখার জন্য সকলের সহায়তা করেন।