না ফেরার দেশে চলে গেলেন জনউন্নয়ন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা কৃষক সংগঠক আ: জব্বার
::ময়মনসিংহ থেকে মো: অহিদুর রহমান::
ময়মনসিংহ জেলার নবঘোষিত তারাকান্দা উপজেলার সাধুপাড়া গ্রামের ঈমাম বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ কৃষক আব্দুল জাব্বার। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার কারণে গ্রামের আর দশটি কৃষক পরিবারের মত তার বাড়িতে সাধারন মানুষের অবাধ বিচরণ ছিলো না। ২০০৮ সালের কথা পার্শবর্তী খিচা গ্রামের নজরুল ইসলামের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার রামেশ্বরপুর ও দুর্গাশ্রম গ্রামের কৃষকরা সংগঠিত হয়ে এলাকার কৃষি সমস্যা সমাধানে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটি শুনে সাধুপাড়া গ্রামের কয়েকজন কৃষককে নিয়ে তিনি সেই কার্যক্রমগুলো দেখার জন্য যান এবং নিজ গ্রামে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে রামেশ্বরপুর ও দুর্গাশ্রম গ্রামের কৃষকদের কাছে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। রামেশ্বরপুর ও দুর্গাশ্রম গ্রামের কৃষকদের সহযোগিতায় ২০০৮ সাল থেকে এলাকার কৃষি সমস্যা সমাধানে নিজ জমিতে ১২টি স্থানীয় জাতের ধান জাত নিয়ে এলাকা উপযোগী ধানের জাত নির্বাচন কার্যক্রম শুরু করেন। এই কাজের সফলতা নিজ গ্রামের কৃষক ও আশে পাশের গ্রামের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেবার জন্য নানামূখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কৃষি সমস্যা সমাধানে অন্যান্য কৃষকদের সহযোগিতার তাগিদ থেকে ২০০৯ সালে বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন বারসিকের সহযোগিতায় তিনি তার নিজ বাড়ির উঠানে আয়োজন করেন কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য মেলার, যেখানে এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। ২০০৯ সালের পর থেকে তিনি ধারবাহিকভাবে নিজ বাড়িতে এই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই কাজের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা মানুষটির চিন্তা ও আচরণের ক্ষেত্রে আনে ব্যাপক পরিবর্তন।
[su_slider source=”media: 181,180,182″]
যে বাড়িতে দুই/তিন বছর আগেও সাধারণ মানুষের সেভাবে কোন বিচরণ ছিলো না এই মানুষটির কল্যাণে সেখানে এখন প্রতিদিনই এলাকার কোন না কোন মানুষ কৃষিকেন্দ্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য ছুটে আসেন। কাউকে পরামর্শ, কাউকে ফসলের বীজ দিয়ে সহযোগিতা করার পাশপাশি সাধ্যমত আপ্যায়নের চেষ্টা করতেন। এলাকার কৃষি সমস্যা সমাধানে কৃষককে সংগঠিত করার জন্য সদা হাস্যোজ্জ্বোল এই মানুষটি বাড়ি থেকে বাড়ি, গ্রাম থেকে গ্রামে, উপজেলায়, জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। নিজ উদ্যোগে কৃষকের সমস্যা সমাধানের জন্য গড়ে তুলেছিলেন সাধুপাড়া কৃষক ঐক্য সংগঠন। গ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার, আর এর জন্য প্রয়োজন একটি স্থানের। এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নিজে জমি অর্থ আর শ্রম দিয়ে সাধাপাড়া গ্রামে নিজের বাড়ির সামনে এলাকার মানুষের জন্য গড়ে তোলেন সাধুপাড়া জনউন্নয়ন কেন্দ্র। শুধু নিজ গ্রাম সাধূপাড়াতেই নয় আশে পাশের গ্রামের কৃষক সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। পাশ্ববর্তী খিচা গ্রামে জাগ্রত কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য সহযোগিতা করেন। তারাটি গ্রামে সিংড়ামুহি কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য পরামর্শ ও সহযোগিতা করেন। তিনি গজহরপুর গ্রামের অবহেলিত নারীদের একত্রিত ও অগ্রসর করার জন্য গজহরপুর গ্রামে মুচিপাড়ায় গজহরপুর নারী সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজণীয় সহযোগিতা প্রদান করেন। তিনি তারাকান্দা, বিশকা, কামারিয়া ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের মানুষকে একত্রিত করেন। নিজ উপজেলা ছাড়াও নেত্রকোনা সদর উপজেলার চল্লিমা গ্রামে গন পাঠাগার, কৃষক সংগঠন তৈরি, স্থায়ীত্বশীল কৃষি চর্চা সম্প্রসারনে তার উৎসাগ ও আগ্রহ গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কোম্পানির বীজ কিনে যারা প্রতারিত হয়েছেন তাদের পক্ষে কাজ করে মিডিয়াতে প্রচার করে, অধিকার আদায় করে কোম্পানিকে জরিমানার আওতায় নিয়ে এসে তবে ঘরে ফিরেছেন এই কৃষক সংগঠক। আ: জব্বার ছিলেন তারাকান্দা অঞ্চলের পিছিয়ে পরা মানুষের পথপ্রদর্শক। তার আদর্শ সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এলাকার কৃষকদের জন্য তার এই নিরলস প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা এলাকার মানুষের কাছে একজন শ্রোদ্ধাভাজন মানুষ হিসেবে পরিচিতি পায়।
২০০৯ সাল থেকে নিজ এলাকার মানুষসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি দেশের বাইরে থেকে অসংখ্যা কৃষক, গবেষক, উন্নয়ন কর্মী তার গ্রামের কৃষকদের কর্মপ্রক্রিয়া পরিদর্শনের জন্য তার বাড়িতে যান ও আলোচনা করেন। বাড়ির সামনে গড়ে তোলা জনউন্নয়ন কেন্দ্রে এলাকার কৃষক, জেলে, কামার-কুমার, শিক্ষার্থী, যুবক, কবিরাজ সকলেরই এক মিলন কেন্দ্র, যাকে কেন্দ্র করে চলে পারস্পারিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা উপকরণের বিনিময়। এই পারস্পারিক সহযোগিতার ভেতর দিয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষক, জেলে, কুটিরশিল্পী, কামার-কুমার, শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কবিরাজ, প্রান্তিক সাধারণ মানুষসহ সকল স্তরের মানুষের স্থায়িত্বশীল জীবন, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় উদ্যোগ, নিজস্ব জ্ঞান অভিজ্ঞতা বিনিময়, স্থানীয় প্রযুক্তি হস্তান্তর, মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, শস্যফসলের বীজ আদান প্রদান, কৃষিক্ষেত্রে বাজার নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতগুলো মোকাবেলা করার কলাকৌশলগুলো রপ্ত করে। এলাকার মানুষর মধ্যে তৈরি হয় সুসম্পর্ক, সম্পৃতি আর সৌহার্দ্যরে মেলা বন্ধন যা গ্রামীণ জীবনের মূল দর্শন। এই প্রক্রিয়াটিকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে আব্দুল জাব্বার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন যিনি আজ আর স্বশরীরে আমাদের মাঝে নেই।
কৃষক আ: জব্বার গত ১৩ জুলাই ২০১৫ সোমবার বিকেল ৫ টায় নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন, ইন্নালিললাহে, অইন্নাইললাইহে রাজিউন। মৃত্যুকালে স্ত্রী, দুইপুত্র, পুত্রবধু, দুই নাতনী রেখে গেছেন। গত দুই বছর ধরে তিরি দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
উল্লেখ্য আব্দুল জাব্বারের নেতৃত্বে সাধুপাড়া গ্রামে কৃষি কেন্দ্রিক গৃহীত উদ্যোগগুলো চ্যানেল আই এর পরিচালক শাইক সিরাজ একাধিকবার পরিদর্শন করেন এবং চ্যানেল আই ও বিটিভির কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান হৃদয়ে মাটি ও মানুষ এবং কৃষি দিবানীশী উনুষ্ঠানে প্রচার করেন। কৃষকের এ ধরনের আয়োজন, আগ্রহ, উদ্যোগ দেখে জনাব শাইখ শিরাজ সাধুপাড়া জনউন্নয়ন কেন্দ্রে একটি রঙিন টেলিভিশন প্রদান করেন। গ্রামীণ সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য তিনি গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করতেন। মানুষকে নির্মল আনন্দ দিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন। গত সোমবারের পর থেকে সাধুপাড়া গ্রামের সদা হাস্যোজ্জ¦ল উদ্যোগি সেই মানুষটি আর জনউন্নয়ন কেন্দ্রে মাসিক জনসংগঠনের সভায় বসে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন না, দিতে পারবেনা কৃষি বিষয়ক নানা ধরনের তথ্য ও পরামর্শ। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুর সংবাদে এলাকার অসংখ্য মানুষ গভীরভাবে শোকাহত হয়। কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু এই মানুষটিকে শেষবারের মত দেখার জন্য ছুটে আসেন নানা প্রান্ত থেকে। নেত্রকোনা জেলা জনসংগঠনের সভাপতি সায়েদ আহমেদ খান বাচ্চু, আটপাড়া উপজেলা জনসংগঠনের সভাপতি আ: ওয়াদুদ খান, জেলে সংগঠক যোগেশ দাস, ময়মনসিংহ অঞ্চলের জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি আ: কালাম মন্ডল, মোশারফ হোসেন গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। বারসিক নিউজ ডট কম এবং বারসিক পরিবারের সবাই তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে এবং তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানায়।