করোনায় বিপাকে উপকুলীয় নিন্ম আয়ের জনগোষ্ঠী
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বর্তমান সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো নোভেল করোনা ভাইরাস। যার ছোবলে গোটা বিশ্ব যেনো থমকে আছে। দিনের পর দিন যেনো মৃত্য মিছিলের সামিল হচ্ছে বিশ্ব। সকালে ঘুম থেকে উঠে টিভিটা চালু করে কোথায় কি হচ্ছে? কোন দেশে কত জন মারা গেছে? আমাদের দেশের কি অবন্থা? আমাদের আশেপাশের আত্নীয় পরিজনদের কোন সমস্যা হয়েছে কিনা? এরকম নানান বিষয়ে খোঁজ নিতেই যেনো দিনটা শুরু হয়। আবার রাতে ঘুমানোর আগে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে ঘুমানো। যেনো এই মহামারী থেকে আমাদের দেশ ও বিশ্ব রক্ষা পায়। এটা যেনো এক নিত্য নতুন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে- আমাদের প্রত্যেক মানুষের জীবনে। কবে কোন দিন যে এটা বন্ধ হবে তা একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া যেনো আর কেউ জানেনা।
২০১৯ সালে ৩১ শে ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে এক প্রজাতির ভাইরাস সংক্রমনের মাধ্যমে এই করোনা ভাইরাসের সুত্রপাত হয়। আর সেখান থেকে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে পুরো বিশ্বে বিস্তার ঘটেছে। যার ছোবলে গোটা বিশ্ব নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক নামী দামি অসংখ্য ডাক্তার, বৈজ্ঞানিক আছে যারা নিমেশের মধ্যে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারে। সেখানে সবাই যেনো দিশেহারা হয়ে পড়েছে কি করে এই মরণ ব্যাধি করোনা থে্কে মুক্তি পাওয়া যায় তা নিয়ে। বিভিন্ন দেশ নানান ভাবে তা চেষ্টা করছে কি করে এই মরন ব্যাধি প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে। সারা বিশ্বের যেনো এখন একটাই কাজ- করোনাকে মোকাবেলা করা। সেদিক থেকে আমাদের বাংলাদেশ নানান উপায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই চেষ্টার মধ্যে সববচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হলো লকডাউন ঘোষনা করা। আর সেটা হয়েছে অনেক পরে এবং তা প্রশাসনের নানান মুখী পদক্ষেপ গ্রহনের পরে।
প্রাথমিক ভাবে আমাদের দেশে হোম কোয়ারেন্টাইন, সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখা, বিদেশ ফেরত এর বাড়ি সিল মারা, দোকানপাট, রাস্তাঘাটে কম চলাচল করা, হ্যান্ড গ্লোভস, মাক্স, সাবান, হ্যান্ডসেনিটাইজার ও হ্যান্ডওযাস ব্যবহার, ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকা এরকম নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আর এখন কোন কোন এলাকা, কোন গ্রাম লকডাউন ঘোষণা করছে। আর এ লকডাউনের মধ্যে সবচেয়ে সংকটরে মধ্যে আছে নিন্ম আয়ের পেশাজীবী জনগোষ্ঠী; যাদের প্রতিনিয়ত বাইরে না বের হলে তাদের একদিনও চলেনা। আমরা জানি যে, বাংলাদেশ ভৌগলিক ও ভূতাত্বিক অবস্থানগত কারণে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি। প্রতিনিয়ত জলবাযু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের মাত্রা যেমন বাড়ছে সাথে ক্ষতির মাত্রা, ক্ষতির পরিধিও বাড়ছে। সাথে সাথে বাড়ছে ঝুঁকিও। এ ঝুঁকির মধ্যে থেকে দুর্যোগের আগে ও পরে থাকে নানান ধরনের পদক্ষেপ যাতে ক্ষতির পরিধি কমিয়ে আনা যায়। আর এখন এক অদৃশ্যমান দুর্যোগ করোনা এসে উপস্থিত। যার ছোবলে সব কিছু নিঃশেষ হতে চলেছে।
বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের মানব সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অহরহ লেগে আছে। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে করোনা দুর্যোগ। উপকুলীয় এলাকার পানি হলো লবণ পানি। আর এ লবণ পানি এবং মানব সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে যেনো তাদের প্রতিনিয়িত স্বাক্ষাত। এখানে আছে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ; এখানে আছে জেলে, বাউয়ালি, মৌয়ালি, চুনোরী, বাগদী, জেলে, আদিবাসি, গাছি, কামার, ভ্যান চালক, দিনমজুর, কুমার, কৃষক, হরিজন, ঋষি, মেথর, নাপিত, মাঝি সহ নানান পেশার মানুষ।
করোনার এই দুর্যোগকালে উপকুলীয় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বিভিন্ন পেশাজীবদের সাথে যোগাযোগের এর মাধ্যমে তাদের আতঙ্ক ও বিপাকে পড়ার কথা জানা যায়। তারা মনে করে এই করোনা দুর্যোগে তাদের মাথায় হাত উঠে গেছে। জীবন চালানো ও বেঁচে থাকা যেনো দুর্বিষহ উঠছে দিনকে দিন। যেখানে আযের জন্য বাহিরে না গেলে এক দিনও চলে না সেখানে আজ কয়েক দিন হলো তাদের ঘরে বসে থাকা। নিজেদের নেই তেমন কোন জমানো সঞ্চয়। তার মধ্যে আছে আবার বিভিন্ন এনজিও ঋণ। এ যেনো এক মরার উপর খাড়ার ঘা। কিছু কিছু পরিচিত মুদি দোকানী ছিলো যাদের কাছ থেকে পাওয়া যেতো নানান সময়ে বাকীতে পণ্যসামগ্রী। সেগুলোও আজ তাদের নিজেদের নিরাপত্তা ও প্রশাসনের চাপে দোকান খুলছে না। এদিকে সরকারী ভাবে সহায়তা করার কথা জানালেও এখনো অনেকের কাছে পৌঁছায়নি সরকারের ত্রাণ সহায়তা। আবার সরকারী-বেসরকারী ও ব্যক্তি পর্যায়ে ত্রাণ সহায়তা কিছু জাযগায় দিলে তা দিয়ে কোন রকমে ২ চার ৪ দিন চলেছে তার পরে সেই একই অবস্থা। বেঁচে থেকেও যেনো মরে যাওয়ার মতো আছি। সংসারের পরিজনদের মুখের দিকে তাকাতে পারছিনা। এখন যদিও কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে খেতে পারছি এছাড়াও বাড়ির আশে পাশে থেকে দু-এক সাজের তরি-তরকারী পাচ্ছি। কিন্তু কতো দিন আর এ ভাবে চলবে। সামনে এর থেকে আরো খারাপ দিন আসবে কিনা তাও বলতে পারছি না।
এ প্রসঙ্গে কাঠালবাড়িয়া গ্রামের কৃষক গৌর চন্দ্র মন্ডল ও শংকরকাটি গ্রামের কৃষানী নাজমা বেগমরা জানান, তারা কৃষক মানুষ কৃষি কাজ করে চলে। নিজেদের বসত ভিটা ছাড়া তেমন কিছুই নেই। সেখানে বারো মাস বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করে। এখনোও এই দুর্যোগের মধ্যে ফসল ফলাচ্ছেন- কিন্তু সে ফসল বিক্রি করতে পারছেন না। ঘর থেকে বের হতেই পারছেন না। যদিও চুরি-চামারী করে বিক্রি করছি তাও মুল্য পাচ্ছেন না। এতে করে সংসার চালানো কঠিন হযে পড়ছে।
বাদঘাটা গ্রামের কাহার সম্প্রদায়ের নাপিত অসিত মন্ডল বলেন, “আমরা তিন ভাই এই নাপিতের কাজ করি। একটা দোকান ছিলো সেখানে তিন ভাই চুল কামানোর কাজ করতাম। আমাদের তিন ভাই ও বাপ-মা সহ আমাদের ১৭ জনের সংসার। কতদিনে আয় রোজগার করে রাখলে ১৭ জন বসে বসে খাওয়া যায়। যেখানে প্রতিদিনের খাবার বাজার প্রতিদিন করতে হতো। আর এখন কিছুই হচ্ছে না। এতে করে খুবই কষ্ট করে সংসার চালাতে হচ্ছে। কিভাবে যে চলবো তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই”।
গোপালপুর গ্রামের ঋষি পরিবারের গীতা রানী দাস ও তার ছেলে নিরাঞ্জন দাস বলেন, “আমরা ঋষিরা যেনো আছি আরো বিপদের মধ্যে। বাঁশ-বেতের কাজ করে আমাদের সংসার চলে। বাড়িতে পরিবারের প্রায় সবাই এ কাজের সাথে যুক্ত। গ্রাম থেকে বাঁশ কিনে এনে তা দিযে নানান ধরনের উপকরণ তৈরি করে শনি ও মঙ্গলবার বাজারে উঠাতাম। আবার গ্রামে গ্রামেও ফেরি করে বিক্রি করতাম। সব কিছু এখন বন্ধ । এতে করে আমাদের আয় রোজগার সব প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে আমরা প্রায় ৮৫ টি ঋষি পরিবার আছি। সবার একই অবস্থায় আছি”।
কল্যানপুর গ্রামের জেলে শীবপদ ধীবর বলেন, “আমরা এ গ্রামে হিন্দু ও মুসলিম মিলে প্রায় ৭৫ টি জেলে পরিবার আছি। আমরা অন্যের ঘেরের মাছ ধরে দেওযা এবং পার্শ্ববর্তী নদী ও খাল থেকে মাছ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাই। এখন যে অবস্থা তাতে করে আমাদের সব আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আগামীর দিন নিয়ে আমরা খুবই শংকায় আছি। কি করে চলবো সে বিষয়ে”।
সৈয়দালিপুর গ্রামের দিন মজুরী খাদিজা বেগম বলেন, “রোজ সকালে উঠে জন-মজুরীর কাজ করতে হয় আমার। কখনো অন্যেরে বাড়ি, কথনো অন্যের ঘেরে, সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে রাস্তা ও পুকুর সংস্কার এর কাজ, ধান কাটা, মাড়াই করা- মানে যখস যে কাজ থাকে সে কাজ করি। আর এখন যেনো কোন কাজ নেই। কাজের জন্য কেউ ডাকছে না। সরকারী ভাবে আমাদের এই আশ্রয়ন প্রকল্পে সহায়তা করার কথা থাকলেও এখনো কেউ করিনি। স্থানীয় সরকার থেকে তালিকা তৈরি করেছে। এখন এক সাজ রান্না করে তিন সাজ খেতে হচ্ছে। সামানে যে আর কি কি দিন আসবে তা বলার উপায় নেই”।
প্রতিবন্ধী ভ্যান চালক সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমি জন্মগত ভাবে একজন প্রতিবন্ধী; আমার এক পাযে সমস্যা। তার পরেও যেনো কারো উপর বোঝা না হই- তাই ইঞ্জিনচালিত ভ্যান চালাই। এতে করে যা রোজগার হতো তাতে আমার ৪ জনের সংসার ভালো ভাবে চলে যেতো। কিন্তু এখন করোনার কারণে বাহিরে যেতে পারছিনা ভ্যান চালাতে পারছি না। সংসারের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে”।
উপকুলীয় এলাকায় এরকম নানান পেশার মানুষ যারা প্রতিনিয়িত বিভিন্ন কাজে সংসারের আয়ের জন্য বাইরে যেতে হয়। মরণব্যাধি এই করোনায় তাদের আয় রোজগার সব বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে তাদের হতাশায় দিনযাপন করতে হচ্ছে। সরকারী-বেসরকারী ভাবে তাদের পাশে এখনো সেই ভাবে কেউ দাঁড়ায়নি। তাদের প্রতিটা দিন কাটছে আতঙ্কে। উপকুলীয় এলাকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দুর্যোগ এসেছে এবং তা সবা্ই কোন না কোন ভাবে মোকাবেলা করেছে। কিন্তু এ মরণব্যাধি করোনা এমন এক অদৃশ্যমান ভাইরাস যা প্রতি পদেপদে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করছে। এতে করে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে সাথে নিন্ম আয়ের মানুষেরা কঠিন বিপর্যের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। আমরা যেমন সবার ভালোর জন্য প্রশাসনের সকল নির্দেশনা মেনে চলার চেষ্টা করছি। ঠিক তেমনি আমাদের নিন্ম আয়ের এই পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারী-বেসরকারী প্রতি প্রতিষ্ঠান, সুশিল সমাজকে এগিয়ে এসে তাদের পাশে সহায়তার হাত বাড়ানো দরকার। সাথে সংকটকালীন সময়ে তাদের জন্য কোন ভাতা বা কার্ডের মাধ্যমে তাদের খাদ্য নিশ্চিৎ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। সেই সাথে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ সবার সচেতনতায় আমাদের করোনা দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হতে পারে।