করোনা থেকে নিজেদের সুরক্ষায় খাসিরা আরও সচেতন
নিরালা পুঞ্জি, শ্রীমঙ্গল থেকে সিলভানুস লামিন
করোনা একটি আতংকের নাম। করোনা একটি অস্থিরতার নাম, একটি অভিশাপের নাম এবং একটি ভয়ের নাম। বিশ^ব্যাপী এটি আজ ত্রাস সৃষ্টি করছে। ধনী-দরিদ্র, সুস্থ-অসুস্থ, নারী-পুরুষসহ সব শ্রেণীর, পেশার এবং জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই এটি আতংক ছড়িয়ে দিয়েছে। নিরালা পুঞ্জির খাসিসহ সিলেটের সব খাসি আদিবাসীদের মধেই আজ এটি একটি ত্রাস, একটি আতংক, একটি অভিশাপ এবং একটি নিষ্ঠুরতার নাম। নিরালা পুঞ্জির খাসি থেকে শুরু করে এই এলাকায় বসবাসরত গারো, বাগানী এবং বাঙালিসহ সবার মুখে মুখে আজ করোনা ভাইরাসের নাম। সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই এই ভাইরাসের নাম। প্রতিদিন দুপুর ২.৩০ মিনিটে সবাই টিভির সামনে বসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিং দেখছেন। আশা করছেন এই বুঝি করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। যারা ব্যস্ততার কারণে টিভির সামনে ওই সময় বসতে পারেনি তারাও পরে অন্যের মাধ্যমে প্রতিদিনের করোনা পরিস্থিতি জেনে নেন। আশা একটাই এই পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে! কিন্তু যখনই শুনেন পরিস্থিতি এখনও তেমন উন্নতি হয়নি সাথে সাথেই হতাশা নিয়ে নিজ নিজ বাসায় চলে যান।
বিগত একমাসের বেশি সময় ধরে পুঞ্জিতে অবস্থান করে আমি এই পুঞ্জির মানুষের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। এই গ্রামে আজ করোনা, কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন খুবই পরিচিতি শব্দ। এই কারণে তাদের ভেতরে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। কাউকে কোয়ারেন্টাইন রাখলে তারা মনে করেন এসব মানুষের ভেতরেও করোনা ভাইরাস প্রবেশ করেছে। সবচে’ দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই কোয়ারেন্টাইন থাকা ব্যক্তিকে তারা করোনা রোগী মনে করেন এবং যাদের সাথে দেখা হয় সেটা তারা প্রচার করেন। ফলে মানুষের ভেতরে আরও আতংক তৈরি হয়। পুঞ্জির বেশিরভাগ মানুষই জানেন না দেশে প্রকৃত করোনা রোগীর সংখ্যা কত।
অন্যদিকে করোনা ভাইরাস নিয়েও তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। কেউ বলেছেন মানুষ বেশি পাপ করেছেন বলে সৃষ্টিকর্তা এই ভাইরাস পাঠিয়েছেন মানুষকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। আবার কেউ কেউ বলেছেন এটি চীনের বিজ্ঞানীরা ছেড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রকে শায়েস্তা করার জন্য। করোনা ভাইরাসে মৃত্যুবরণকারীদেরকে কবর না দিয়ে নদীতে ফেলা হয় এরকম কথাও শুনেছি। ফলশ্রুতিতে অনেকে মাছ খাচ্ছেন না এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে। আবার কেউ কেউ মনে করেছেন পশু পাখি থেকে এই ভাইরাস এসেছে। ফলে অনেকে মাংস, ডিম খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বারসিক এর প্রতিনিধি হিসেবে আমি অনেকের সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছি, সচেতন করার চেষ্টা করি। করোনা নিয়ে তাদের ভেতরে বিভ্রান্তি রয়েছে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করেছি। কোয়ারেন্টাইনে থাকলেই যে সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে সেটা ভাবা ঠিক নয়। বরং আক্রান্ত এলাকা থেকে কেউ আসলে তাকে ১৪ দিনে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়। ১৪ দিনে কোয়ারেন্টাইনে থাকার পর যদি কারও মধ্যে এই ভাইরাসটি থেকে থাকে সেটি প্রকাশ পাবে এবং কোয়ারেন্টাইনে থাকার কারণে সেটি অন্য জায়াগায় ছড়িয়ে যেতে পারবে না। করোনা ভাইরাসে মৃত্যুবরণকারীদের খুব সাবধানে কবর দেওয়া হয়; নদীতে ফেলা হয় না, সেটাও জানানোর চেষ্টা করি। তাই মাছ, মাংসসহ প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়ার উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করি।
গ্রামের যুবকরা তুলনামূলকভাবে বেশি সচেতন। তারা স্ব উদ্যোগে গ্রামের ওষুধ (ব্লিচিং পাউডার) ছিটিয়ে দিয়েছেন। অনেকে তাদের পরিবার পরিজনকে নিয়মিত হাত ধোয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। গ্রামের বাইরে আসার পর তারা হান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারে উৎসাহ দিয়েছেন। সবাই যাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করেন সেজন্য গ্রামের মুরুব্বীদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেই আলোচনা করেছেন। তাই গ্রামে এখন নিয়মিত সভা হয় না; বরং একজন বা দু’জন সংবাদবাহক দিয়ে প্রতিটি পরিবারে গ্রামের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, তথ্য জানানো হয়। ফলশ্রুতিতে পূর্বেই তুলনায় মানুষ অনেক সচেতন হয়েছেন।
গ্রামে লক ডাউন থাকার কারণে হেডম্যানের অনুমতি ছাড়া কেউ গ্রামের বাইরে যেতে পারেনি এবং বাইরে থেকে যাতে কেউ গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রতিদিন ৪ জন ব্যক্তি গ্রামের প্রবেশ মুখে পাহাড়া দেন। এভাবে প্রথমদিককার তুলনায় বর্তমানে গ্রামের মানুষ অনেকটা সচেতন হয়েছেন। করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা যেমন বাসায় অবস্থান করেছেন ঠিক তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছেন।