প্রকৃতি আমার নাকি আমি প্রকৃতির !
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম : ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চৈতালি কাব্য গ্রন্থে এভাবেই প্রকৃতিকে ধ্বংস করার সেই আক্ষেপের কথা তুলে ধরেছিলেন ১৮৯৬ সালের দিকে। প্রায় দেড়শত বছর পরও সেই ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা আজও বহমান। বরং আরো নিদারুণ হয়েছে সেই নিষ্ঠুরতা। প্রকৃতি মানেই প্রাণের সম্মিলন, প্রাণ মানেই এক অবিচ্ছেদ্য প্রকৃতি। কোটি কোটি প্রাণের সম্ভারে সেজেছে এই প্রকৃতি। যেখানে মানুষ নামের কেবলি আমি একটি প্রাণী। আমার সব কিছুকে ঘিরেই এই প্রকৃতি। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্য ছাড়া আমার বাঁচাই অসম্ভব। তবুও প্রকৃতির প্রতি আমার নির্দয় আচরণ শেষ হবার নয়! তাই প্রশ্ন জাগে প্রকৃতি আমার জন্য বেঁচে আছে, নাকি আমি প্রকৃতির জন্য বেঁচে আছি। খুব সহজ উত্তর। সবাই জানি। তবুও নির্দয়তা থেমে নেই আমাদের। বছর যায় বছর আসে। বিভিন্ন দিবসের মধ্যে দিয়ে পরিবেশ প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র্যকে সুরক্ষার গান গাই। সচেতনতা ছড়ায়। সচেতন হই। ঘুরে ফিরে কিছু মানুষের মধ্যেই যেন এই সচেতনতা। আবার জেনে বুঝেও নির্দয় হই এই প্রাণ, প্রকৃতির প্রতি।
আজ ২২ মে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস ২০২০। জীব তথা প্রাণবৈচিত্র্য সম্পর্কে গোটা বিশ্ববাসীকে সচেতন করতেই জাতিসংঘ ২২ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে এই দিবসটি উদযাপন হয়ে আসছে। বিশ্বে মহামারি কারোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এবার জাতিসংঘ এই দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘প্রকৃতির মাঝেই আমাদের সকল কিছুর সমাধান’ (ঙঁৎ ংড়ষঁঃরড়হং ধৎব রহ হধঃঁৎব).
প্রকৃতির নৈকট্য লাভের মধ্যে দিয়েই মানুষ বেঁচে আছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে তা ভুলে যাই আমরা। আমরা মানুষ যখন এই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তথা প্রকৃতির বৈচিত্র্যময়তাকে নিজ হাতে খুন করি, আসলে তা মানুষ হিসেবে নিজের অস্তিত্বকেই দুর্বল করার জন্যই খুন করি। এই মানুষ আমি! আমার বসবাস বৃক্ষের তলে। আমার নিশ্বাস বৃক্ষের অক্সিজেনে। আমার খাদ্য এই প্রকৃতির হাজারো প্রাণবৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে। আমার চিকিৎসা, আমার সভ্য হয়ে উঠার গল্প এই প্রাণবৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে। আমি মাত্র একটি প্রাণী এই পৃথিবীর। এটা ভুলেই যাই আমি। আমার মতো একটি প্রাণী না থাকলেও এ প্রাণ প্রকৃতি, এ পৃথিবী দিব্যি চলবে। খুব ভালো করেই চলবে। এ প্রকৃতি আরো সুন্দর নির্মল হবে। মহামারি করোনাকালের বিশ্ব পরিবেশ ও প্রকৃতির যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা মানুষ হিসেবে এখনো আমি পুরোটাই স্বীকার করতে পারিনা কেন? প্রকৃতি থেকে যখনই মানুষ দুরে সরে গিয়েছে তখনই ধ্বংস ডেকে এনেছে সে নিজের। গবেষকদের ধারণা প্রকৃতি পরিবেশের ধ্বংসের প্রতিশোধ নিচ্ছে মহামারি করোনা ভাইরাস।
তবুও মহামারির এই ধ্বংসের মধ্যেও প্রকৃতি বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের। আমার চারি পাশের সবুজ বন, শস্যখেত, নদী নালা, খাল বিল ও সমুদ্র, পাহাড় সবকিছু, প্রকৃতির সবকিছু দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এসবের উৎস থেকেই আমার বেঁচে থাকার সকল রসদ সংগ্রহ করা হয়েছে। তবুও নির্দয় কেন আমি এই প্রাণপ্রকৃতির প্রতি। আমি ভুলে যাই, কোন মোবাইল কোম্পানি আমাকে বাঁচিয়ে রাখেনি। আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আমার পাশের প্রাণপ্রকৃতি ও পরিবেশ।
আমি শাসন করতে চাই আমার প্রাণপ্রকৃতিকে। মানুষ আমি,দাস বানাতে চাই এই পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যকে। আসলেই কি তাকে শাসন বা দাস বানানোর কোন সক্ষমতা আছে আমার ? মানুষ! পৃথিবী নামক গ্রহকে নাকি সে শাসন করছে। নিজেই সেই ঘোষণা দিয়েছি। আসলেই কি সেই সক্ষমতা আর শক্তি আছে আমাদের? নেই । আসলেই নেই। এই পৃথিবীর কোটি কোটি প্রাণের মধ্যে মানুষমাত্র একটি প্রাণী। তাই এ কথাটি বলতেও কার্পণ্য লাগছে মানুষ ও প্রকৃতি একে অপরের পরিপূরক। প্রকৃতি কখনোই মানুষের মুখাপেক্ষি নয়। মানুষই প্রকৃতির মুখাপেক্ষি। তাই এই প্রাণপ্রকৃতি রক্ষা করা মানুষেরই বড় কর্তব্য। এই প্রাণপ্রকৃতি যতো ধ্বংস হতে থাকবে, ততোই মানুষ নামক একটি প্রাণীর জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা দুর্বিসহ হয়ে উঠবে। মানুষ হিসেবে আমি যেমন প্রকৃতির একটি অংশমাত্র তেমনি আমিও প্রকৃতির, প্রকৃতি আমার। এই প্রকৃতিকে রক্ষা করা আমার একটি সব থেকে বড়ো দায়িত্ব। সবকিছুর উপরে, সব থেকে বড় দায়িত্ব প্রকৃতিকে রক্ষা করা। এই প্রাণবৈচিত্র্যকে রক্ষা করা। এর থেকে আর কোন বড় দায়িত্ব হতে পারেনা মানুষের জন্য। এই দায়িত্বের মধ্যে দিয়েই নিজ নিজ ধর্ম, দর্শন, তত্ত্ব, সাংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার রক্ষা করা সম্ভব।