করোনা মহামারী ও কৃষকের বীজের অধিকার

কেন্দুয়া নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রূমী:
বীজ গ্রামীণ নারীদের সম্পদ। গ্রামীণ নারীরা নিজ উদ্যোগে এবং নিজেদের প্রয়োজনে বৈচিত্র্যময় ফসলের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করেন। স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় সবজি, মসলা ও অন্যান্য ফসলের বীজ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব থেকেই কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের নগুয়া গ্রামের ‘সবুজ-শ্যামল কৃষক সংগঠনে’র সদস্যরা নিজ উদ্যোগে গ্রামেই গড়ে তোলে স্থানীয় জাতের একটি বীজঘর। বৈশ্বিক দূর্যোগ করোনা পরিস্থিতিতে কৃষাণী রোকেয়া আক্তারের এর নেতৃত্বে এলাকার ৫টি গ্রামের ২০০ জন কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে স্থানীয় ১৪ জাতের সবজি বীজ (পুইশাক, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, চালকুমড়া, আশ্বিনা সীম, খৈলসা সীম, কাইক্কা সীম, বরবটি, ধনিয়া, মিষ্টি সজ, করলা, ধুন্দল, ঢেড়স ও শসা) ও দুই জাতের বারমাসি মরিচ বীজ (সাদা উব্দা মরিচ, কালো উব্দা মরিচ) বীজ বিনিময় করেন। গত মৌসুমে বীজঘর থেকে যেসকল কৃষক-কৃষাণী বীজ সহায়তা নিয়ে চাষ করেছিলেন তারা সেসব সবজি বীজ সংরক্ষণ করে কিছু কিছু করে বীজঘরে বীজ ফেরত দেন। বোরো মৌসুমে আবুল কালাম ৮টি জাতরে ধানের বীজ বীজঘরে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বীজঘরের ব্যবস্থাপক কৃষাণী রোকিয়া আক্তার নিজের সংরক্ষিত বীজ এবং কৃষক-কৃষাণীদের বীজঘরে দেয়া বীজ নিজ গ্রাম ছাড়াও পার্শ্ববর্তী প্রায় ৯টি গ্রামের ৫০ জন কৃষক-কৃষাণীর মধ্যে বিতরণ করেছেন। বীজ বিতরণকৃত গ্রাম গুলো হল- আশুজিয়া, পাড়ার্দূগাপুর, সিংহেরগাঁও, রাজিবপুর, ভুগিয়া, মনাং, ফচিকা, দরুনবালি ও কাইলাটি এবং বিতরণ ও বিনিময়কৃত সবজির জাতগুলো হল- লাউ, সীম, মিষ্টিকুমড়া, শসা, কালো মরিচ, ঝিঙ্গিা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বীজ সহায়তা পেয়ে এসব গ্রামের অনেক কৃষক-কৃষানী নিজ নিজ পরিবারের সবজির চাহিদা মিটিয়ে বাজারের সবজি বিক্রি করেছে এবং নিজেরাই প্রয়োজনীয় বীজ সংরক্ষণ করেছে। করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রামে ফেরত আসা ৫০টি পরিবারকে রোকেয়া আক্তার তার নিজের চাষকৃত সবজি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। বীজঘর থাকর ফলে কৃষক কৃষানীদের মধ্যে বীজ সংরক্ষণের আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। বীজঘর স্থাপন ও বীজ বিনিময় কার্যক্রম শুরুর পূর্বে গ্রামের অধিকাংশ কৃষক-কৃষাণীই বীজের জন্য বাজারের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বর্তমানে গ্রামের সকলে বীজঘর থেকে বীজ নিয়ে কৃষাণী রোকিয়া আক্তার, সখিনা আক্তার,কৃষক আবুল কালামেরমত গ্রামের অনেক কৃষক-কৃষানীরা সবজি চাষ করছেন। ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই, সন্তানদের লেখাপড়া ও স্বাস্থ্য সেবাসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সংগঠনের আলোচনার ফলে সদস্যরা এসব বিষয়ে দক্ষতা লাভ করেছে। সংগঠনের বেশকিছু সদস্য বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের সম্পদ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছে। রোকেয়া আক্তার জৈব বালাই নাশক, জৈব সার তৈরী ও বীজ সংরক্ষণে অভিজ্ঞ হওয়ায় তার বাড়ীর আশেপাশের নারীসহ আত্মীয়দের সাথে তিনি তার অভিজ্ঞতা নিয়মিত সহভাগিতা করে থাকেন।

কৃষাণী রোকিয়া আক্তার স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ, বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিনিময় ও পরিবেশসম্মত উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের সাথে সহভাগিতার ফলে এখন গ্রামের অধিকাংশ মানুষই তাদের উৎপাদিত ফসলের বীজ সংরক্ষণ করছেন এবং পরস্পরের সাথে বিনিময় করছেন। রোকিয়া আক্তারের সহযোগিতায় ও পরামর্শে গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে বীজের জন্য পরস্পারিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পারস্পারিক বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা প্রয়োজনীয় বীজ সংগ্রহ করতে সক্ষম হওয়ায় বীজের জন্য তাদের বাজারের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পেয়েছে। এর মাধ্যমে বৃদ্ধি পাচ্ছে কৃষকদের পারস্পারিক আন্তঃনির্ভরশীলতাও। কৃষি ক্ষেত্রে রোকিয়া আক্তারের অবদান কৃষকের অধিকার ও কৃষির স্থায়িত্বশীলতা আনতে যথেষ্ট ভূমিক রাখবে বলে আমরা আশাবাদী। দেশের প্রতিটি গ্রামে ও সমাজে রোকিয়া আক্তারাই কৃষির হাল ধরে আসছেন এবং স্থানীয় জাতের শস্য ফসল চাষ করে ও বীজ সংরক্ষণ করে কৃষিকে টিকিয়ে রেখেছেন এবং আগামীতেও রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আর এভাবেই কৃষি চিরকাল অটুট থাকবে। আর এজন্য প্রতিটি গ্রামে গ্রামে প্রয়োজন রোকিয়া আক্তারের মত নারীর।

happy wheels 2

Comments