পরিবেশ ও সার্বিক উন্নয়নে হৃদয় কেন্দুয়া যুব সংগঠনের উদ্যোগসমূহ
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
যুব সমাজই আগামী দিনের ভবিষ্যত। যুব প্রজন্ম তাদের এবং প্রবীণদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে দেশের শিক্ষা ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করে আরো সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতিতে উন্নত করেছে। যুব প্রজন্মই সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে এবং এলাকার সার্বিক উন্নয়নে বেশ কিছু ব্যতিক্রমি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা উল্লেখ করার মত। ‘হৃদয় কেন্দুয়া যুব সংগঠন’ নেত্রকোনা জেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের এমনই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যে সংগঠনটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইউনিয়নের শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ, স্বাস্থ্য, সামাজিক অসংগতি ও কুসংস্কার দূরীকরণ, মাদকমুক্ত যুব সমাজ গড়া, বাল্যবিবাহ মুক্ত ও নারী নির্যাতন মুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে অবিরামভাবে কাজ করে চলেছে। এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে নির্মল সাংস্কৃতিক চর্চার অংশ হিসেবে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা, সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, প্রকৃতিকে জানা, স্কুল পর্যায়ে দেয়ালিকা তৈরি ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে ২০১৭ সাল থেকে।
হৃদয় কেন্দুয়া যুব সংগঠনটি এপ্রিল ২০২০ থেকে বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে লকডাউন চলাকালীন সময়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, কর্মহীন ও দরিদ্র পরিবারের জন্য খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, স্বাস্থ্য ক্যাম্প আয়োজন, পবিত্র ঈদে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, বৃক্ষ রোপনসহ বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। সংগঠনের নিয়মিত কাজেরই ধারাবাহিকতায় এপ্রিল ২০২১ থেকে সংগঠনটি কোভিড-১৯ সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা, উপকরণ বিতরণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সেবা প্রদানসহ করোনাকালীন লকডাউন সময়কালীন সময়ে এলকার উন্নয়নে এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর সহায়তায় বেশ কিছু মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করে সাধ্যমত বাস্তবায়ন করেছে। নি¤েœ হৃদয়ে কেন্দুয়া যুব সংগঠনের এপ্রিল ২০২১ থেকে গৃহীত উদ্যোগ ও বাস্তবায়িত উদ্যোগগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হল:
করোনা সংক্রমণ রোধে মাস্ক বিতরণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি
যুব সংগঠনটি আশুজিয়া বাজারের ৩০ জন দোকানীর সকলকে মাস্ক বিতরণ এবং দোকানে সবসময় বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধান করা এবং বাইরে গেলে মাস্ক পড়া নিশ্চিত করেছে। বাজারে আগত দরিদ্র ও নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১০০টি মাস্ক বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। এছাড়াও “মাস্ক না পড়লে পণ্য বিক্রি হয়না’ লেখাযুক্ত লিফলেট বাজারের প্রতিটি দোকানে লাগিয়ে দিয়েছে। যুব সংগঠনের সদস্যরা বাজারে আগত ক্রেতা-বিক্রেতাদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মাইকে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা এবং মসজিদে এবং বাজারে জীবানুনাশক স্প্রে করাসহ সকলকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে সহযোগিতা করেছে।
খাদ্য উপকরণ বিতরণে ফ্রি হাট
রমজান মাস উপলক্ষে যুব সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামের অসহায় দরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য নোয়াদিয়া একতা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে একটি ফ্রি হাট বসিয়ে বিনামূল্যে খাদ্য উপকরণ বিতরণ করা হয়। হৃদয় কেন্দুয়া যুব সংগঠনের উদ্যোগে সদস্যদের বাড়িতে যে সব শাকসবজি যেমন-বেগুন, শসা, গোলআলু, কুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, কাঁচামরিচ, পেয়াজ উদ্বৃত্ত বা মজুদ রয়েছে তার থেকে একটি সামান্য অংশ সংগ্রহ করে গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। করোনাকালীন সংকটে এলাকার খেটে খাওয়া কর্মহীন ১০০টি দরিদ্র পরিবারকে পবিত্র ঈদ উৎসবে চিনি, সেমাই ও হাত ধোয়ার সাবান সহযোগিতা করেছে।
পবিত্র ঈদে প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের মাঝে পোষক বিতরণ
সংগঠনটি গ্রামে অবস্থিত একটি প্রতিবন্ধি স্কুলে নিয়মিত উপস্থিত হয়ে প্রতিবন্ধি শিশুদের শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করে থাকে। এরই অংশ হিসেবে সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিবন্ধি স্কুলের ৫০ জন দরিদ্র প্রতিবন্ধি শিশুদের জন্য ৫০টি ঈদের পোষাক দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। নতুন পোষক পেয়ে প্রতিবন্ধি শিশুরা স্কুলে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
পাখি সংরক্ষণে গাছে মাটির হাড়ি টানানো
২২ মে ২০২১ প্রাণবৈচিত্র্য দিবসে সংগঠনের উদ্যোগে আশুজিয়া গ্রামের বড় বড় গাছগুলোতে ১০০টি মাটির হাড়ি বেঁধে দিয়ে বৈচিত্র্যময় পাখিদের জন্য নিরাপদ বাসস্থান ও অভয়াশ্রম তৈরী করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এলাকায় সকল ধরণের পাখি শিকার বন্ধে প্রচারণা চালানো হয়েছে। এছাড়াও প্রাণবৈচিত্র্য দিবসে সংগঠনের সদস্যরা এলাকার মাটি, প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় সকলকে পলিথিন ব্যাগ বর্জনে শপথ করায়। পলিথিন ব্যাগ পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। পলিথিন পচে না এবং মাটিতেও মিশেনা। পলিথিন ব্যাগ আমদানিকারী ও বিক্রেতাদের আইনত শাস্তি ও আর্থিক জরিমানার বিষয়েও ৩টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের তারা সচেতন করে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপন ও বৃক্ষ রোপণ
সংগঠনের সকল সদস্যরা পরিবেশ সম্পর্কে বেশ সচেতন। নেত্রকোনা অঞ্চলে বৈচিত্র্যময় জাতি, ধর্ম, পেশা ও ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের বসবাস। এসব জাতি ধর্ম ও পেশার জনগোষ্ঠীই টিকিয়ে রেখেছে এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশকে। কিন্তু দিন দিন এসব বৈচিত্র্যময় পেশা আজ বিলুপ্তপ্রায়। পেশা বিলুপ্তির সাথে সাথে মানুষও প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আজ বিপন্নপ্রায়। তাই মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় এলাকার নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর, পাহাড়, বন, পুকুর ও সবুজ প্রান্তর রক্ষা করা আজ সময়ের অত্যন্ত আবশ্যকীয় বিষয়। তাই সংগঠনটি ৫ জুন ২০২১ বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপন এবং দিবসকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী বৃক্ষ রোপণ অভিযানের উদ্যোগ নিয়েছে। এবিষয়ে সংগঠনের অন্যতম সদস্য আলমগীর হাসান সনি বলেন, ‘আামদের গ্রামের পাশেই এক সময় দু’টি ভরা নদী (সাইঢুলি ও পাটেশ্বরী) ছিল, সে নদীতে আমরা গোসল করা থেকে শুরু করে মাছ ধরা, নৌকা চালনা, সাতাঁর শেখা, গবাদী পশুর গোসল করানো এবং কৃষি ফসল উৎপাদনে সেচ কাজে নদীর পানি ব্যবহার করতাম। কিন্তু গ্রামের পাশের এই নদীগুলো আজ বিলুপ্তপ্রায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বছরেরর মাত্র তিন থেকে চার মাস নদীতে পানি থাকে, বাকী সময়টা পানি শূন্য থাকে, গোসলের পানি পর্যন্ত থাকেনা। গ্রামের বনভূমিও আজ নেই বললেই চলে। কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বৈচিত্র্যময় গাছের উপস্থিতি অতিব জরুরী। তাই আমরা হৃদয়ে কেন্দুয়া যুব সংগঠনের উদ্যেগে ৫ জুন ২০২১ রোজ শনিবার আশুজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যারয় প্রাঙ্গনে তিন জাতের ৫০টি ফলের চারা রোপণের মাধ্যমে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপন করেছি। রোপণকৃত ৫০টি ফলদ গাছের চারার মধ্যে ১০টি আম, ২০টি কাঁঠার ও ২০টি জামের চারা। এছাড়াও সংগঠনের উদ্যোগে আমরা পরিবেশ সুরক্ষায় মাসব্যাপী আশুজিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, বাজার ও রাস্তার পাশের খালি জায়গাগুলোতে ধাপে ধাপে মোট ৫০০টি ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
সংগঠনের অন্যতম উদ্যোগী যুবক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘শিল্পায়নের ফলে অর্থনৈতিকভাবে দেশের অনেকটা উন্নয়ন হলেও অন্যদিকে পরিবেশগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশ অনেকগুণ পিছিয়ে। গ্রামাঞ্চলে যত্রতত্র মৎস্য খামার ও গবাদী পশুর খামার গড়ে মানুষ শুধু মূনাফা লাভের প্রতিযোগিতায় মত্ত। আর এজন্য গাছপালা কেটে তৈরি করা হচ্ছে খামার ও শিল্প কারখানা। পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের দিকে কারো নজর দেয়ার ফুসরত নেই। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের সংগঠনের অধিকাংশ সদস্য ঘরে রয়েছে। আর এই সময়টাতে আমরা পরিবেশসহ এলাকার সার্বিক উন্নয়নে ছোট ছোট উদ্যোগ গ্রহণ করে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নিজেরা সাধ্যমত চাঁদা দিয়ে এবং এলাকার পরিচিত জনদের নিকট থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে জুন মাসব্যাপী আশুজিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও এলাকার রাস্তার পাশে ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছি, পাশাপাশি এলাকার জনগণকে কমপক্ষে দু’টি করে ফলদ/কাঠ/ঔষধি গাছের চারা রোপণের জন্য উৎসাহিত করছি। বর্তমান কৃষি অনেক উন্নত হয়েছে, এবছর চারা রোপণ করলে আগামী বছরেই ফল খাওয়া যায়। তাই অবহেলা না করে এবং বাজারের রাসায়নিক উপকরণ দ্বারা বাজারজাত ফলের উপর নির্ভর না করে নিজে ফলের গাছ লাগিয়ে নিরাপদ ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবারের ভিটামিন ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য সকলকে বৃক্ষ রোপণে উদ্বুদ্ধ করছি। আমাদের এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন নিশ্চিত হবে বলে আমি মনে করি।’
হৃদয়ে কেন্দুয়া যুব সংগঠনের এলকার জনগোষ্ঠীর শিক্ষার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সরকারি/বেসরকারি সেবা পরিসেবা প্রাপ্তিতে সহযোগিতা, শীত নিবারণ, বাল্যবিয়ে ও যৌতুক প্রথা দূরীকরণ, মাদক থেকে যুব সমাজকে সুরক্ষা, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ পাখির অভয়াশ্রম তৈরিসহ এলাকার পরিবেশ উন্নয়নে বৈচিত্র্যময় বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ আশুজিয়া ইউনিয়নবাসী, শিক্ষক এবং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের নিকট বেশ সমাদৃত হয়েছে। জুন মাস বৃক্ষ রোপণের উৎকৃষ্ট সময় তাই এই সময়ের মধ্যে প্রত্যেকে যদি একটি করে কাঠ, ফলদ বা ঔষধি গাছের চারা রোপণ করি তবে অবশ্যই আমাদের দেশের পরিবেশ সুরক্ষিত হবে। তাই আসুন আমরা নিজেদের প্রয়োজনে বাড়ির খালি স্থানগুলোতে পছন্দের গাছ রোপণ করে পরিবেশ উন্নয়নের অংশীদার হই, পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের জন্য নিরাপদ ফল সুনিশ্চিত করি।