বাহন যখন ঘোড়া!
মানিকগঞ্জ হরিরামপুর থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
ঘোড়া মানুষের প্রিয় সঙ্গীগুলোর মধ্যে একটা। আধুনিক মানুষের বাহন এখন যন্ত্রনির্ভর, কিন্তু একটা সময় ছিল ঘোড়া ছিল মানুষের একমাত্র বাহন ও বিপদের বন্ধু। আমাদের ভারতে উপমহাদেশসহ বিশ্বের সকল জায়গায় ঘোড়া হলো একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। মোঘল আমল, সেন যুগ, ব্রিটিস আমলেও আমাদের অঞ্চলে ঘোড়া হলো সবচেয়ে বিশ্বস্ত বাহন ও প্রহরী। ঘোড়াকে পণ্য আনা নেয়ার কাজসহ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো। বিভিন্ন রাজা-জমিদারদের আমলে আমরা ঘোড়া নিয়ে দেখতে ও শুনতে পাই নানান কাহিনী আর গল্প। শেরশাহ, আওরঙ্গজেব, টিপু সুলতান, নবাব সিরাজদৌলাসহ অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের সাথে ঘোড়ার সম্পর্ক রয়েছে।
এই ঘোড়ার প্রচলন এখন বিশ্বব্যাপী কমে গেলেও ঘোড়া আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জ, পাহাড়, চরাঞ্চলের অন্যতম গৃহপালিত প্রাণী। আমাদের গ্রাম দেশে এখনও ঘোড়া গাড়ীর ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। তেমনই মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের প্রান্তিক চরাঞ্চলের জনপ্রিয় বাহন হলো ঘোড়ার গাড়ি। চরাঞ্চলের মানুষের জীবন খুবই সংগ্রামময়ী জীবন। চরের নিয়মই হলো নদীর এই পাড় ভাঙবে আবার ঐ কূল গড়ে উঠবে। এই ভাঙা গড়ার চর হরিরামপুরে বয়ড়া ইউনিয়নে বর্তমান গ্রামগুলো দীর্ঘ ১০ বছর নদীর গর্ভে ছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যায় পলি জমে জমে এই চরের জন্ম হয় আর মানুষ তাতে বসবাস শুরু করে।
মানুষের এই নতুন জীবনের সঙ্গী হয় আবার সেই ঘোড়াই। এই ঘোড়ার উপর ভিত্তি আবার চরের মানুষের জীবন পরিচালিত হচ্ছে। চর এলাকা তুলনামুলক নিচু হওয়ায় প্রতি বর্ষায় চাষকৃত জমিতে পলি পড়ে চাষাবাদে উপযোগী হয়। চর এলাকার লোকজন ধান, গম, পায়রা, তিল, খেসারী, মুগ, মাসকলই, শরিষা, ধনিয়া, রাধুনি, কালিজিরা, পিয়াজ, রসুন, ভুট্টা, চাষাবাদ করে জীবিকা নিবাহ করে থাকে। এই কৃষি পণ্য আনা নেয়ার পরিবহনের দায়িত্ব পালন করেন ঘোড়ার গাড়ী।
লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের পাটগ্রামচরের ঘোড়ার গাড়ি চালক আলমগীর হোসেন (৩৫) বলেন, “আমি ১২ বছর ধরে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে পদ্মার চরে ঘোড়ার গাড়ি চালাই । প্রতিদিন আমি ৭০০ থেকে ১০০০ পর্যন্ত টাকা রোজগার করতে পারি। ঘোড়ার গাড়ি সারাবছর চলে। কারণ ফসল সংগ্রহ থেকে শুরু করে লোকজনের যাতায়াত, দোকান পাটের মালামাল পরিবহন সহ সারাবছরই কাজে লাগে।” অন্যদিকে হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ ইউপি সদস্য শহীদ মোল্লা (৫০), বলেন, “চরের রাস্তার উপযোগী বাহন হলো ঘোড়ার গাড়ি। কারণ হলো চর এলাকার সকল রাস্তাই কাঁচা। তবে ঘোড়ার গাড়িতে কাঁদা রাস্তায়ও মালামাল বহনে কোন ধরনের সমস্যা হয় না।
চরের লোকজন জানান, ঘোড়ার খাবারের জন্য আলাদাভাবে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয় না। চরাঞ্চলে নলখাগড়া, কাইশ্যা, কলমী, খরমা, গইচা, বাদাল, দুর্বলা, জলদুর্বা, হেনচি সেচি, বাইতা, হেলেঞ্চা, তেলাকুচা, ফেচি, বেউথা, নুনইটা ইত্যাদি ঘাস জন্মায় যা ঘোড়ার খাবার হিসেবে ব্যবহ্নত হয়। এছাড়া ঘোড়ার খাদ্য হিসেবে গমের ভূষি, ছোলা, পায়রার ভূষি, মাসকালাইর ভূষি ব্যবহার করে থাকেন। একটি ঘোড়ার গাড়িতে করে ২০ থেকে ২৫ মণ পর্যন্ত মালামাল বহন করা যায়। চরে কাচা রাস্তা, ভাঙ্গাচুরা গর্ত, উচুনিচু, কাঁদাপানি থাকার কারনে ভ্যান, রিক্স্রা, ভটভটি বা ইঞ্জিন চালিত গাড়ি চলতে পারে না। ঘোড়ার গাড়ি পরিবেশ উপযোগী, কাঁদা বৃষ্টিতে মালামাল বহনে বা যাতাযাতের কোন সমস্যা হয় না।
এক কথায় ইতিহাসের পাতায় ঘোড়া যেমন এক ত্যাজী আর পরাক্রমশালী চরিত্র আজ একইভাবে হরিরামপুরসহ চরাঞ্চলের মানুষের কাছেও ঘোড়া হলো বিপদের বন্ধু, একমাত্র বিশ্বস্ত বাহন।