পরিবারভিত্তিক পশুপালন জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে ভূমিকা রাখে
সিলভানুস লামিন
বিশ্বের প্রায় এক বিলিয়ন দরিদ্রতম জনগোষ্ঠী পরিবারভিত্তিক পশুপালন তথা মুরগি, হাঁস, শূকর, গরু, ছাগল এবং অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণী পালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেক কৃষক ও পশুপালকের জীবিকায়নে পশুপালন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন-একজন গরিব মানুষ একটি ডিম বিক্রির মাধ্যমে কিছু পরিমাণ চাল কেনার সামর্থ অর্জন করে এবং দিনে একবেলা খাবার গ্রহণের পরিবর্তে তার দু’বেলা খাদ্য গ্রহণের বাস্তবতা তৈরি হয়। চলতি লেখাটি পরিবারভিত্তিক পশুপালনের সাথে গ্রামীণ মানুষের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি কীভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে কীভাবে এটি ভূমিকা রাখে তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
পালিত পশু দরিদ্র মানুষের পরিবারই সদস্য
দরিদ্র মানুষেরা পরিবারভিত্তিক পশুপালন করে থাকে সরাসরি ভোগের জন্য, দুধ, ডিম ও মাংস পাওয়ার জন্য, সার, জ্বালানি ও ঔষুধ (পশুদের মূত্র কীটনাশক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়) পাওয়ার জন্য। প্রাণী ও প্রাণীজ দ্রব্য কৃষিসহ অন্যান্য কর্মসূচির জন্য ইনপুট প্রদান করে যেমন-কৃষিমাঠ কর্ষণ, মালামাল বহন, শক্ত মাটির ডলা ভাঙন, বীজের অঙ্কুরোদগম ও ছড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করে। পশুর চারণক্ষেত্র দাবানল রোধ করে এবং পশুদের মূলমূত্র সার ও কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া গরিব মানুষদের যখন নগদ অর্থের প্রয়োজন হয় তখন পালিত পশু বিক্রি করে তাদের চাহিদা পূরণ করে থাকে। তাই তো দেখা যায়, নগদ অর্থের প্রয়োজনের সময়ই গরিব মানুষদের পশু বিক্রির হার বেশি; পশুর দাম বেশি হওয়ার সময়ে নয়। শুধু তাই নয় দরিদ্র মানুষেরা তাদের পালিত পশুগুলোকে পরিবারের এক একজন সদস্য হিসেবে বিবেচনা করে। পালিত পশু বিভিন্ন সামাজিক উৎসবের অন্যতম নির্দেশক। বিভিন্ন সামাজিক উৎসব ও পার্বণগুলো পালিত পশুর ওপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়, যেমন-গরুর গাড়ি দৌড়ের প্রতিযোগিতা, মোরগ লড়াই, ষাড়ের লড়াই, সুন্দরী প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। পশুপালন ও যত্ন করা তাই সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নিত্যদিনের জীবনযাত্রারই একটি অংশ যা বর্তমান আধুনিক যুগেও এর আবেদন কমে যায়নি। কোন কোন দেশে পালিত পশু মারা গেলে পালক তার সৎকার করে; বিভিন্ন সামাজিক প্রথা অনুসরণ করে। পশুপালন পরিবারের অন্যতম একটি সাধারণ কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় কোন পশু মারা গেলে, বিক্রি করা হলে কিংবা চুরি হলে গৃহকর্তা শোক পালন করে। অন্যদিকে Van der Ploeg ২০০৯ সালে প্রকাশিত তার ঘবি New Peasantries বইয়ে পশুপালনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকটির গুরুত্ব উল্লে¬খ করে বলেছেন যে, পশুপালন সংস্কৃতি পণ্যের উৎস, গুণগতমান, নির্ভরযোগ্যতা ও সতেজতার অর্থ বহন করে এবং এটি পণ্যের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণের সহযোগী পন্থা। এ কারণে বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি পশুপালন খাতে একটি অংশগ্রহণমূলক বা প্রতিনিধিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে কিছু প্রতিবেদনের মতে, কৃষিখাতের ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত মোট নাইট্রোজেনের ৫০ ভাগ আসে সার থেকে যা কৃষিখাতের জন্য পশু পালনের অতীব প্রয়োজনীয়তাকে নির্দেশ করে। পশুপালন খাতের রয়েছে বিভিন্ন ব্যবহার ও কার্যাবলী যদিও এই খাত এখনও অনেকটা অবহেলিত।
গ্রামীণ উন্নয়ন
১৯৯৯ সালে যখন পশুপালন বিপ্লব (Livestock Revolution) আবির্ভূত হয়েছে তখন অনেকে ধারণা করেন যে, সবুজ বিপ্লবের মতো এটি কেবল বহুজাতিক কোম্পানি এবং বৃহৎ ও ধনী কৃষকদের লাভবান করাবে না; বরং দরিদ্র ও ক্ষুদ্র পশুপালক ও কৃষকও এতে লাভবান হতে পারে। বিশ্বে মাংস, ডিম ও দুধের ক্রমবর্ধমান চাহিদা দরিদ্র মানুষের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেবে যেখানে তারা পশুপালন বিপ্লবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাজারগুলোতে প্রবেশ করার সুযোগ পাবে। কিন্তু ১০ বছর পর Ugo Pica Ciammara and Joachim Otte তাদের Livestock Revolution: Rhetoric and reality-এ দেখান যে, শুধুমাত্র চীন, ব্রাজিল ও ভারতে মুরগি, শূকর পালন এবং ডেইরি খামার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেলেও আফ্রিকায় এর উন্নয়ন হ্রাস পেয়েছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্থবির রয়েছে। এছাড়া পশুপালন খাতে একটি ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। বিশ্বব্যাংকের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন বিভাগের জিমি স্মিথ স্বীকার করেছেন যে, বিশ্বে প্রাণীজ পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির হার সমান নয়। তিনি বলেন, চীনে মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশগুলোতে এর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রত্যাশা মতো ক্ষুদ্র ও দরিদ্র পশুপালকরা এতে লাভবান হতে পারেনি বাজারের সাথে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সামর্থ্য না থাকার কারণে। তার মতে, বড় ও ধনী পশুপালকরাই পশুপালন বিপ্লবে সবচে’ বেশি লাভবান হয়েছে। এ খাতে পাবলিক বিনিয়োগ কম, ভেটেনারি সেবাসমূহ অপ্রতুল এবং ক্ষুদ্র ও দরিদ্র পশুপালকদের বাজারের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করা কিংবা বাজারে তাদের প্রবেশাধিকার তৈরিতে কম বিনিয়োগ এবং সর্বোপরি পশুপালন প্রক্রিয়াকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে স্থায়িত্বশীল করার বিষয়ে স্বল্প বিনিয়োগের কারণে ছোট ও দরিদ্র পশুপালকরা এতে লাভবান হতে পারছেন না বলে তিনি মনে করেন। পশু পালনের জন্য আনুষাঙ্গিক যেসব বিষয় প্রয়োজন সেগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার কারণে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও ক্ষুদ্র পশুপালকরা সেসব সেবা লাভ করতে পারছে না। কারণ ভেটেরনারি সেবাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার কারণে এর লক্ষ্য ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ থেকে সরে এসে নতুন লক্ষ্য পূনঃনির্ধারিত হয় এবং সেটি হচ্ছে ‘লাভের জন্য স্বাস্থ্য’। তাই এই খাতে গ্রামীণ মানুষের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাদের জন্য বাজার প্রবেশাধিকার সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামীণ মানুষের উন্নয়নের জন্য পশু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে যা ইতিমধ্যে আলোচনা হয়েছে। সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পশুপালন ব্যবস্থাপনা এবং বাজারে প্রবেশাধিকার সহজ ও নিঃশর্ত হলে এবং সর্বোপরি পশুপালনের জন্য প্রয়োজনীয় আনুষাঙ্গিক উপকরণ ও সেবা গ্রামীণ মানুষেরা নাগালে পৌছানো গেলে এটি দিয়ে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
পশু পালন ও জলবায়ু পরিবর্তন
২০০৬ সালে প্রকাশিত “Livestock’s Shadow: Environmental issues and Options” শীর্ষক বিশ্ব খাদ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশুপালন খাত থেকে ১৮% বৈশ্বিক গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়; তবে এই নিঃসরণ মূলত পশুপালনকে কেন্দ্র করে মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে হয়েছে। বিশেষ করে যেসব দেশ বাণিজ্যিক পশুপালনের সাথে জড়িত তারাই এইখাত থেকে বেশি পরিমাণ গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। পরিবারভিত্তিক পশুপালন থেকে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার উল্লেখ করা না হলেও এই হার যে কম তা বলাই বাহুল্য। কারণ এইখাতে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ক্ষেত্রে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো পরিবারভিত্তিক পশুপালনের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। বলা হয়, পশুর ঢেকুর তোলা ও পেটফাঁপা থেকে নিঃসৃত হয় মিথেন গ্যাস, পালিত পশু ঘর তৈরির জন্য গাছ কাটা ও পোড়া থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং পশুখামারে রাসায়নিক সার ছিটানোর মাধ্যমে নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসৃত হয় যা বিশ্বে মোট গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হারকে দ্রুততর করে। পারিবারিক পশু পালনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত উপাদান কম নিঃসৃত হয়। অবশ্য বলতে হয় যে, বিশ্বে এক দেশের পশুপালন প্রক্রিয়ার সাথে আরেকটি দেশের পশু পালন প্রক্রিয়ার মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনি রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যও। এই ভিন্ন প্রক্রিয়া ভিন্ন পরিমাণ ও ভিন্ন ধরনের গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। Jonathan Safran Foer-এর Eating Animals-সহ বিভিন্ন গবেষকের গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, সমগ্র আফ্রিকার পরিবারভিত্তিক পশুপালন থেকে মাত্র ৩% মিথেন গ্যাস নিঃসৃত হয়। তাই আফ্রিকার অনেক পশুপালন প্রক্রিয়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ এই প্রক্রিয়াটি কার্বন নেতিবাচক। International Livestock Research Institutes (ILRI) এর মতে, একটি ২৫০ কেজি আফ্রিকা গরু বছরে মোট ৮০০ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন করে কিন্তু এটি বছরে প্রতি হেক্টরে মোট ১৪০০ কেজি কার্বন শোষণ করে। এভাবে প্রকৃতিকে ভারসাম্য অবস্থায় রাখতে এটি ভূমিকা পালন করে। একইভাবে বলা যায়, যেসব ডেইরি প্রক্রিয়ায় ‘খড়’ প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেটি কম কার্বন উৎপাদন করে মূলত গুণগতভাবে ভালো ডায়েট প্রদানের কারণে এবং বেশি পরিমাণ শক্তিকে রিসাইকেল বা পুনঃনবায়ন করার সক্ষমতার কারণে। পরিবারভিত্তিক পশুপালনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে যা উল্লেখ করার মতো। বাণিজ্যিক পশুপালনের সাথে তুলনায় স্বাধীন পরিবারভিত্তিক পশুপালন অধিক লাভজনক, যা ভারত ও ফিলিপাইনে দেখা যায়। ছোট আকারের পরিবারভিত্তিক মুরগি ও শূকর পালন বৃহৎ আকারের ফার্মের তুলনায় পরিবেশের ওপর তুলনামূলকভাবে কম নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।
তাই পরিবারভিত্তিক পশুপালনকে উৎসাহিত করা এবং এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন ঘটানোর জন্য পশুপালনের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা ও উপকরণ সহজলভ্য করা এবং বাজারে যাতে সাধারণ মানুষেরা প্রবেশ করতে পারে সেটিরও নিশ্চিয়তা দিতে হবে।
Farming Matters (2010) ম্যাগাজিন অবলম্বনে