“আগে রাখতাম ফসল,এখন রাখি পানি”
সাতক্ষীরা থেকে শাহীন ইসলাম
কালিরাণী জোয়ারদার। উপকূলীয় শ্যামনগরের উপজেলার আড়পাঙ্গাশিয়া গ্রামের গৃহিনী। কালিরানী বলেন,“ছোট বেলায় বাবার বাড়ি এবং বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে দেখেছি পরিবারের বিভিন্ন কৃষি ফসল যেমন-ধান, সরিষা, ডাল, সবজি, মসলার বীজ গোলাঘর, আউড়ী, মেটে, কলস, মাটির হাড়ি ও ভাড়ের মধ্যে যতœ করে রেখে দিত। যখন সময় হত, তখন পাত্রগুলো থেকে বীজ বের করে চাষ করত বাপ-কাকা-ঠাকুর দা। তখন পানির কষ্ট ছিল না। চারিদিকে মিষ্টি পানির পুকুর আর পুকুর। যখন প্রয়োজন হত পুকুর থেকে পানি নিয়ে আসতাম।” তিনি আরও বলেন, “কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রামে নোনা পানি এসে মিষ্টি পানির সব পুকুর নষ্ট করেছে। এখন গ্রামে খাবার পানির পুকুরের সংখ্যা খুবই কম। আইলার পর আমাদের খাবার পানির কষ্ট আরো বেড়েছে। খাবার পানি সংকটের মূল কারণ চিংড়ি চাষ।” তিনি জানান, এখন গ্রামে কৃষি জমি নেই বললে চলে। সোনার কৃষি জমিতে নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করেছে। আগের মত গ্রামে ফসল চাষ হয় না। কৃষক ফসলের বীজ হারিয়ে ফেলেছে। পূর্বের ফসল বীজ রাখার সকল পাত্রে এখন মানুষ বর্ষার পানি ধরে রাখেন। এখন ফসলের চেয়ে ওই এলাকার মানুষের কাছে পানির দাম অনেক বেশি। আইলায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের খাবার পানির সকল উৎসগু। অথচ তিনি কখনও তার জীবন দশায় সুপেয় পানির এত সংকট কোন দিন দেখিনি। প্রতি বছর মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত আমাদের পানির জন্য অতিরিক্ত সময়-শ্রম এবং অর্থ ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে বর্ষাকালে মানুষ হাড়ি, পাতিল, জগ, মগ মেটে, কলস, পলিথিন, ড্রাম, ট্যাঙ্কে পানি ধরে রাখেন। চেষ্টা করেন সঞ্চয় করা পানি দিয়ে বছরের ৫/৬ মাস কিভাবে চলা যায়। শুধু তাই না। আগে বাড়িতে কোন উৎসব অনুষ্ঠান কখন করা হবে তা নির্ভর করত ফসলের উপর। আর এখন নির্ভর করে পানির উপর। অথচ আমাদের চারিধারে পানি আর পানি। আর সে কারণেই কালি রাণী জোয়ারদারের আক্ষেপ “আগে রাখতাম ফসল, এখন রাখি পানি”।
উপকূল অঞ্চলের এই নারী তার জীবন দশায় সুপেয় পানির একাল সেকালের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন কৃষি এবং উৎসব অনুষ্ঠানের দৃষ্টিকোণ থেকে। কালি রাণীর উক্তির যথার্থতা বিচারের জন্য উপকূল অঞ্চলে সুপেয় পানির প্রেক্ষাপট, সংকট, সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে ধারণা অর্জনে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:
সুপেয় পানি বিপন্ন উপকূলীয় একটি জনপদ
ভৌগলিক ও প্রতিবেশগত ভিন্নতায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল লবণাক্ত। উপকূলীয় সকল জনপদের মত সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার ভূগর্ভস্থ পানিও লবণাক্ত। ফলে এ অঞ্চলে জনবসতির শুরু থেকেই মানুষ তার জীবন জীবিকার প্রয়োজনে মিষ্টি পানির নানান উৎস-খানা, পুকুর, ডোবা, মজাপুকুর, শিশেল খাল, খাল ইত্যাদি খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করত। খানা ও ডোবার পানি সাধারণত পরিবারের গৃহস্থালির কাজে, মজাপুকুরের পানি গবাদিপশু জন্য, শিশেল খাল ও খালের পানি বসতভিটায় সবজি ও ধান চাষে সেচের জন্য, স্থানীয় মাছের ক্ষেত্র, কুড়িযে পাওয়া খাদ্য উৎস ও গবাদিপশুর পানির ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার হত। আর পুকুর শুধুমাত্র খাবার ও গোসলের জন্য ব্যবহার করত স্থানীয়রা। কিন্তু অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ এবং আইলা জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় শ্যামনগর জনপদের সুপেয় পানির সকল উৎস চরমভাবে ক্ষত বিক্ষত করেছে।
ঘূর্ণিঝড় আইলার শ্যামনগর উপজেলার ৪ হাজারের বেশি সংরক্ষিত পুকুর, এক হাজারের বেশি পিএসএফ এবং ১৩ হাজারের বেশি টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৫০টি পিএসএফ ও তার সন্নিবেশিত পুকুর, ৮০০টি টিউবওয়েল এবং আরো ৮০০টি পুকুরের পানি সম্পূর্ণ লবণাক্ত হয়ে যায়, যেখান থেকে মানুষ সুপেয় পানি সংগ্রহ করত। এক কলস পানির জন্য একজন নারীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কার্ড হাতে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগে সুপেয় পানির ক্ষতিগ্রস্ত উৎসগুলোর প্রায় ৮০ ভাগ ব্যবহার উপযোগী করলেও সুপেয় পানির সংকট চরমভাবে দৃশ্যমান। এছাড়া, বিগত কয়েক দশক ধরে কৃষি জমিতে চিংড়ি চাষ করায় সুপেয় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১২ সালের পহেলা এপ্রিল বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর শ্যামনগরে মাঠ পর্যায়ে করা গবেষণায় স্থানীয় প্রতিবেশ এবং প্রাণবৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের জন্য লবণ পানিকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গবেষণায় বলা হয়, স্থানীয় জনগণ তাদের গবাদিপশু, নানান জাতের ফসল, মাছ, বনজ খাদ্যসহ সকল প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্তি/বিপন্নতার জন্য লবণ পানি দায়ী।
বর্তমানে, উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ৫৭৯৫টি পুকুর ও ১৩৬টি জলমহাল রয়েছে। এক হাজার ৪১২টি গভীর নলকূপ থাকলেও বন্ধ রয়েছে ৮টি। অগভীর নলকূপ রয়েছে ৪২২, বন্ধ রয়েছে ৩টি। তাছাড়া, অধিকাংশ নলকূপে লবণ পানি ওঠে। ৩০৪টি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগার রয়েছে। সরকারি –বেসরকারিভাবে খাবার পানি সংরক্ষণে এলাকার মানুষকে ট্যাংক, ফিল্টার, ড্রাম দেওয়া হয়েছে। পিএসএফ, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম রয়েছে। তারপরও ব্যবস্থাপনার অভাবে অধিকাংশ সুপেয় পানির উৎস নষ্ট পড়ে আছে।
উপরোক্ত তথ্য পর্যালোচনায় উপকূলীয় শ্যামনগরে সুপেয় পানির সংকট চিত্র ফুটে উঠেছে। আর সুপেয় পানির সংকট মোকাবেলায় পূর্বের ফসল বীজ সংরক্ষণের পাত্রগুলো এখন পানির দখলে। মূলত ব্যবস্থাপনার অভাবে উপকূলের অধিকাংশ সুপেয় পানির উৎস নষ্ট পড়ে আছে। শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সমগ্র উপজেলায় ৪৫৩টি পিএসএফ থাকলেও ১৮২টি বন্ধ। বেসরকারিভাবে আরো ৬০০ পিএসএফ থাকলেও বন্ধ রয়েছে প্রায় ২০০ পিএসএফ।
উপকূলীয় এলাকায় যথার্থভাবে বিশুদ্ধ পানির যোগান নিশ্চিত করতে প্রয়োজন গবেষণা। গবেষণার মাধ্যমে বিদ্যমান পানি সংকট নিরসনে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, ইউনিয়ন পরিষদ এবং নির্ধারিত সংস্থা বা কর্তৃপক্ষকে নিবিড়ভাবে সহায়তার পাশাপাশি সুপেয় পানির সকল উৎসের টেকসই ব্যবস্থাপনার গাইডলাইন নির্ধারণে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় পানি নীতির ৪.১২ ধারায় বলা হয়েছে”…জাতীয় পানি সম্পদের অব্যাহত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার আওতায় পরিবেশ ও তার জীববৈচিত্র্য ধারণ, সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ”। এ ধারায় কৃষি জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও লোনাপানি অনুপ্রবেশের কারণে পরিবেশ সমস্যার কথা উল্লে¬খ করা হযেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে থেকে স্বাদু পানির উপর এক একটি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক পানি দিবস পালিত হয়ে আসচ্ছে। পানি সংকট এবং বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বিশ্বের সকল দেশ প্রতি বছর দিবসটি পালন করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষসহ প্রতিটি প্রাণের সুস্থ জীবনযাপনের পূর্ব শর্ত উপযোগি পানি।