দুলাল মিয়ার বাড়ি যেন কৃষিপ্রতিবেশীয় শিক্ষা কেন্দ্র
নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমনা
সবুজ বিপ্লব বা আধুনিক কৃষি, অধিক উৎপাদন বা উন্নয়ন যাই বলি মূলতঃ এর মধ্য দিয়েই বর্তমান কৃষকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে কৃষিব্যবস্থা। দিনকে দিন কমে যাচ্ছে কৃষক, আন্তঃ নির্ভরশীলতা, সহযোগিতা, জ্ঞান অভিজ্ঞতা ও পরস্পর বিনিময় প্রথা। এই পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহ তারাকান্দা উপজেলার বিশকা ইউনিয়নের খিচা গ্রামের দুলাল মিয়ার বাড়িতে পা রাখলেই চোখে পড়ে ভিন্ন কিছু দৃশ্য, বদলে যায় ধ্যান-ধারণা, স্বস্তি ফিরে আসে, অনুপ্রেরণা যোগায়। তার গৃহশিক্ষক বাবার হাত ধরেই কৃষি কাজে মনোনিবেশিত হয়ে শৈশব থেকেই বাবার পরিশ্রম সহভাগিতার মধ্য দিয়েই কৃষিতে জ্ঞান, দক্ষতা অর্জন করেন দুলাল মিয়া। বর্তমানে তার বয়স ৪৬+ বছর। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাই দুলাল মিয়াকে করেছে প্রকৃত কৃষক। আগ্রহ ও নিজস্ব চিন্তায় তার বাড়ীটি তৈরি করেছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কৃষক নিয়ন্ত্রিত কৃষিবাড়ি।
৯৬ শতাংশ জমির এক পাশে বসত ঘর এবং জায়গাজুড়ে সারি সারি ফলজ, ঔষধি, বনজ ও সবজির প্লট/মাঁচা তৈরি করেছেন। বাড়িতে বছরে ১২ মাস হরেক রকম ফসল চাষ করেন তিনি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবজি বাজারে বিক্রি ও নিকট আতœীয়দের মাঝে বিতরণ করেন। সমস্ত সবজির এবং স্থানীয় জাতের ধান বীজ তিনি নিজেই সংরক্ষণ করেন। খিচা জাগ্রত কৃষক সংগঠনের সদস্য, সে সংগঠনে এবং গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের মধ্যে বীজ বিনিময়, সংরক্ষণের পরামর্শ ও সহযোগিতা করেন। তথ্য সংগ্রহের সময় দুলাল মিয়া বলেন, ‘গত একবছরে তিনি ১৫ জাতের (ধান ও সবজ্বি) বীজ ৮৪ জন কৃষকের মধ্যে বিতরণ/বিনিময় করেছেন।’ তিনি বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক’র সাথে যুক্ত আছেন সাধুপাড়া কৃষক সংগঠনের জনউন্নয়ন কেন্দ্রের সংযুক্তির মাধ্যমে।
তাঁর বাড়িতে আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, জাম্বুরা, বিলেম্বু, তাল, আমড়া, খেজুর, পেঁপে, বেল, নারকেল, সুপারি, কামরাঙ্গা, ডালিম, কমলা, বড়ই, জলপাই, লেবু, তেতুল, সাজনা, আতাফল, জামরুল, কদবেল, সফেদা, চালতা ইত্যাদি ফলদ গাছ রয়েছে। ঔষধি গাছ হিসেবে আছে হরতকি, তেজপাতা, পান, বাসক, থানকুনি, আপন, ধুতুরা, লজ্জাবতী, ডালিম, খারাজুরা, নিম, এরাইচ এবং বনজ গাছ রয়েছে-শিমূল, বান্দরলড়ি, বদ্দিরাজ, রেন্ট্রি, ছেদাউজা, কালাউজা, বাঁশ, শীল কড়ই, শেউড়া, মাছেরকাটা, পটই, রঙ্গি, চাউ। এছাড়া তিনি আলু, বেগুন, বাটিশাক, সিম, লাউ, লালশাক, ডাটা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, ধুন্দল, পুইশাক, কচ, মুখিকচু, পাটশাক, টমেটু, করলা, মূলা, সরিষাশাক, ঝিংগা, চিচিঙ্গা, কাকরুল, আলু শাক, ঢেরস, কাচা কলা, বরবটি শাকসবজি চাষ করেন। অন্যদিকে অন্যান্য ফসলের মধ্যে রয়েছে আদা, হলুদ, মাছ আলু, পাট, মরিচ, পেয়াজ, রসুন, গুয়ামুড়ী, গজআলু, মাসকালাই ও আখ, কচু, কলমিশাক, এলুঞ্চি, দলকলস, খুরেশাক, কচুর লতা, বিলাতি ধনিয়া পাতা। তিনি ধানও চাষ করেন। তার চাষকৃত ধানগুলো হলো কালিজিরা, হরি, কুমড়ী, আইজং, ঝাপিবোরো, বোরোআবজি, বিরই, সুবাশ মুক্তা, ব্রি-২৮,২৯, ৪৯, ৩৪।
তিনি তার নিজস্ব গরুর লাঙ্গলে জমি চাষ করেন। তার পালনে বর্তমানে ৫টি গরু, ৩টি ছাগল, ৬টি হাঁস, ৩০টি মুরগি, একজোড়া কবুতর এবং এছাড়াও রয়েছে পোষা প্রাণি ১টি কুকুর ও ২টি বিড়াল। প্রাণবৈচিত্র্য প্রেমিক দুলাল মিয়া বলেন, “কাউকে মন দিয়ে ভালোবাসলে তারাও প্রতিদান দেয়, যেমন আমি একদিন বাজারে গিয়ে ফিরতে দেরি হয়, এই দিন আমার একটি গরু বাড়ির পাশের ক্ষেতে ডিগরা দেওয়া (ঘাস খাওয়ার জন্য বেধে রাখা) ছিল আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। তারপর তাড়াতাড়ি করে বাড়ি ফিরে গরুর খুজে বের হয়ে পড়ি। আম¥ার নিকট শুনতে পাই আমাদের পোষা কুকুরটি গরুর খুট কামড় দিয়ে মাটি থেকে তুলে গরুটি বাড়িতে এনেছে এবং একইভাবে আমার পোষা বিড়ালটি একাধিকবার পাশের বাড়ির পুকুরের বড় মাছ কামড় দিয়ে নিয়ে পালিয়ে আমাদের বাড়িতে এনে ফেলে দিয়েছে। বিড়াল থাকায় আমার বাড়ি/সবজি ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ পোহাতে হয় না। বাড়িতে অপরিচিত মানুষ/চুর ঢুকলে কুকুটি জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে আমাদের সজাগ করে এবং পরিচিত অতিথিদের ক্ষেত্রে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে সহায়তা করে।”
ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে দুলাল মিয়া নিজের তৈরি কেচো কম্পোস্ট, গর্ত কম্পোস্ট, কুইক কম্পোস্ট, ছাই, গোবর এবং জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করেন। এতে তার উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়। তার বাড়িতে ১২ ফুট দ্ধ ৩১/২ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি কেচো কম্পোস্ট হাউজ রয়েছে। তার উৎপাদিত কম্পোস্ট সার তার প্রয়োজনের ৬০% চাহিদা পূরণ করে। তিনি জৈব ব্যবস্থাপনা, বীজ সংরক্ষণ, পশুপালনের উপর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। নিজস্ব আগ্রহ, চিন্তা ভাবনা ও প্রশিক্ষণলব্ধজ্ঞানের সমন্বয়ে তিনি এখন দক্ষ তথ্য বিজ্ঞ ব্যক্তি হিসাবে গড়ে ওঠেছেন। তার এই অর্জিত জ্ঞান জনউন্নয়ন কেন্দ্র, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষক সভা এবং এককভাবে সহভাগিতা করে থাকেন। তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা প্রয়োগ, বীজ সংরক্ষণ, পশুপালন, জৈবসার উৎপাদন ইত্যাদি পরিশ্রমের সহভাগিতা ও অনুপ্রেরণা যোগান তাঁর স্ত্রী। কৃষিতে সফলতার অংশিদার তার স্ত্রী সমানে সমান। দুজনের সমন্বয়েই পরিচালিত হয় তাদের সংসার।
দুলাল মিয়ার বাৎসরিক আয় গড়ে উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল, দুধ বিক্রি বাবদ-৪০ হাজার, ধান বিক্রি-২৫ হাজার, হাঁস-মুরগি, ছাগল ২৫ হাজার, সর্বমোট ৯০ নব্বই হাজার টাকা এবং ব্যয়-নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র (কাপড়, তেল-ডিটারজেন্ট, ঔষধ ইত্যাদি) ২০ হাজার, কৃষি উপকরণ ১৫ হাজার, ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা বাবদ ১০ হাজার টাকা, মোট-৪৫ হাজার টাকা। প্রতিবছরই দুলাল মিয়া তার সাংসারিক খরচ বাদে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে গড়ে ৫০ পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করেন।
দুলাল মিয়া পড়ালেখার সুযোগ না পেলেও তার ছেলে মেয়েদের তিনি সুশিক্ষিত মানুষ করতে চান। এক ছেলে ও দুই মেয়ে মা এবং স্ত্রী মিলে ৫ সদস্যের সংসার তাঁর। ছেলে দশম শ্রেণী এবং মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ও ছোট মেয়ে ২ বছর বয়স। ছেলে পড়ালেখার পাশাপাশি বাবাকে কৃষি কাজে সহযোগিতা করে। দুলাল মিয়া বলেন, ‘আমি আমার বাবার মাধ্যমে প্রকৃতি এবং পরিবেশ থেকে যে জ্ঞান পেয়েছি, আমার ছেলে-মেয়েদেরও সেই জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে যেতে চাই। তারা যদি কোন অফিসে চাকুরি করে সেখান থেকে যেন এদেশের বেশিরভাগ মানুষের পেশা কৃষিকাজ নিয়ে, কৃষি সম্পদ রক্ষায় অসহায় কৃষকের পক্ষে কথা বলে, তাহলেই কৃষি থাকবে কৃষকের নিয়ন্ত্রণে, কৃষক পাবে তার প্রাপ্য মর্যাদা।’