গৌরাঙ্গ চন্দ্র বর্মণের হিদল ও তার জীবন
নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান
দারিদ্রতার সাতকাহনে মোড়া জেলেদের জীবন। এত নাই নাই, হাহাকার, শূন্যতার মাঝেও বৈরিতার ভিতরে স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন বুনেন অনেক উদ্যোগী মানুষ। গ্রামীণ জীবন-জীবিকা প্রকৃতিনির্ভর হওয়ায় জনগোষ্ঠীর স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে লোকায়ত জ্ঞাননির্ভর প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, লোকায়ত চর্চার মধ্য দিয়ে চলে প্রান্তিক মানুষের জীবন। জল, জাল, নদী, হাওর, বিল কিছুই আর জেলেদের নিয়ন্ত্রণে নেই। দিনদিন কমে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ, দখল হয়ে যাচ্ছে জলমহাল, শুকিয়ে যাচ্ছেনদী, নালা, খাল-বিল, মাছের অভয়াশ্রম, প্রজনন কেন্দ্র, বিলূপ্ত বিপন্ন মাছের প্রজাতি, হারিয়ে যাচ্ছে পেশা, জীবনে নেমে আসছে দারিদ্রতা। জীবনের চাকাকে চালু রাখার তাগিদে এখনো অনেক জেলে তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা দিয়ে চর্চা করে চলেছে জীবনোপযোগী উদ্যোগ। জীবন্ত রেখেছেন প্রতিদিনের আয় উপার্জন। মাথা উচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে আরো দশজন জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া জেলেকে।
তেমনই একজন জেলে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের জানমা সংগঠনের সদস্য গৌরাঙ্গ চন্দ্র বর্মণ। জলমহাল থেকে বিতারিত হলেও ফুরিয়ে যায়নি তাঁর জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা! তাঁর জীবনের এই সম্পদ ব্যবহার করে পুঁটি মাছের হিদল দিয়ে সংসারের অভাব দূর করে জীবনে এনেছেন সুখের আলো।
গৌরাঙ্গ চন্দ্র বর্মণ ছোটকাল থেকেই তার বাবার হাত ধরে নদীতে গিয়েছেন, নৌকার বৈঠা ধরে, জাল বেয়ে, মাছ ধরে, শুটকী দিয়ে, বিক্রি করে জ্ঞান অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। পুঁটি মাছ প্রক্রিয়াজাত করে হিদল করা হয়। গৌরাঙ্গ হিদল তৈরির একজন পাকা কারিগর তিনি। গত ৪ বছর ধরে হিদল তৈরি করে জীবন সংসার সচল রেখেছেন। এবছর তিনি নয়টি মটকাতে হিদল দিয়েছেন। মোট দশ মণ হিদল হবে বলে তিনি জানান। প্রতিটি মটকা তিনি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন। এই হিদল তৈরি করতে তাঁর খরচ হয়েছে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। তিনি বলেন, “বাজার ভালো থাকলে এ বছর এক লাখ ৫০ হাজার টাকা আয় করতে পারবো।” কার্তিক মাস এলেই পুঁটি মাছ খরা জালে, কনুই জালে, টাকজালে ধরা পরতো। সারারাত ধরে নারীরা পুঁটি মাছ কাটতো। মাছের তেল সংগ্রহ করতো।
হিদল বিপদের বন্ধু। চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে জেলেদের যখন কোন মাছ ধরার সুযোগ থাকে না তখন হিদল শুটকী বিক্রি করে জীবন জীবিকা পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, “এখন নদী, নালা, খাল, বিল না থাকায় পুুঁটি মাছ পাওয়া যায় না। হিদলের জন্য পুঁটি মাছ সংগ্রহ করতে অনেক কষ্ট হয়। মোহনগঞ্জেরে হাওর থেকে সংগ্রহ করতে অনেক খরচ হয়ে য়ায়। তবুও আমাদের পেশা ও জীবন জীবিকার জন্য অন্য পেশায় যেতে পারি না। আমাদের পেশা আমাদের কাছে পবিত্র।”