প্রতিবেশীর সহযোগি হালিমা বেগম
রাজশাহী তানোর থেকে অমৃত সরকার
“বিপদে অন্যকে সহযোগিতা করতে পারলে নিজের মনের কাছে শান্তি লাগে, আবার সৃষ্টিকর্তাও খুশি হন।” কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার আড়াদিঘী গ্রামের হালিমা বেওয়া (৬০)। রাতের আধার বা দিনে আলো যখনই গ্রামের কোন মানুষ অসুস্থ হয় তখনই সবার আগে ছুটে যান হালিমা বেগম রোগীর পাশে থেকে সহযোগিতা করতে। তিনি প্রশিক্ষিত কোন ডাক্তার নন। তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে রোগীর গুরুতর কিছু হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র অথবা মেডিকেলে নিয়ে যেতে হয়। তখন তিনি ওই রোগীদের যান, সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সহযোগিতা কনে।
যেভাবে শুরু
মাত্র ২ বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার কারণে লেখাপড়া করতে পারেন নি হালিমা বেগম। ১৪ বছর বয়সে একই গ্রামের মো. আ. জব্বারের সাথে তাঁর বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। প্রায় ছয় মাস হলো স্বামী মারা গেছেন। বিয়ের দুই বছরের মাথায় তাঁর বাবাও মারা যান। হালিমা বেগমের শ্বাশুরী ধাত্রীর কাজ করতেন। মূলত শ্বাশুরীর কাছ থেকেই গল্প শুনতেন কিভাবে এই কাজ করা হয়। পাশাপশি শ্বাশুরী গৃহপালিত প্রাণীরও প্রসবে সহযোগিতা করতেন। শ্বাশুরীর কাজে অনুপ্রাণীত হয়ে আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে হালিমা বেগম ধাত্রীর কাজ শুরু করেন। এভাবে মানুষের সেবায় কেটে গেছে কতগুলো বছর। তারপরও ক্ষান্ত নন হালিমা বেগম। গ্রামের এমন কোন পরিবার নেই যে পরিবারে হালমা বেগম সহযোগিতা করেননি! কোন রোগীর অপারেশন করতে হবে চার থেকে পাঁচ দিন ক্লিনিকে থাকতে হবে, রোগীর পরিবার থেকে বলার আগেই হালিমা বেগম তাঁদের সাথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকেন।
এ বিষয়ে হালিমা বেগম বলেন, “আমার স্বামী কখনই আমাকে বাধা দেয়নি বরং তিনি সব সময় বলেছেন মানুষই মানুষকে সহযোগিতা করেন।” এ বিষয়ে একই গ্রামের মোঃ সাবের হোসেন (৪৫) বলেন, “হালিমা বেগম থাকাতে আমাদের গ্রামের সকলেরই সুবিধা হয়। একজন নারী হয়েও মানুষের বিপদে তিনিই সবার আগে উপস্থিত হন।” হালিমা বেগম নিজ গ্রামসহ পাশের সালামপুর গ্রাম, তালন্দ গ্রাম মিলিয়ে বিগত ত্রিশ বছরে ১৮৯টি বিভিন্ন অপারেশনের রোগীর সহযোগিতা করেছেন। এছাড়াও তিনি গ্রামের অধিকাংশ গবাদি পশুর প্রসবে সহযোগিতা করেছেন। এভাবে অধিকাংশ ভালো ডাক্তার সম্পর্কে হালিমা বেগম অবগত। আর এই কারণেই গ্রামের অনেক শিক্ষিত মানুষ ডাক্তার দেখানোর আগে হালিমা বেগমের কাছ থেকে পরামর্শ নেন।
হালিমার সংগ্রাম
হালিমা বেগমের বড় দুই মেয়ে এবং ছোট একটি ছেলে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পর হঠাৎ করইে স্বামী অসুস্থ হয়ে প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারান। পরিবারের অল্প একটু জমি, জমানো টাকা যা ছিল সব শেষ করে ধার দেনা করেও স্বামীকে সুস্থ করতে পারেননি। সঙ্গত কারণেই সংসারের সকল দায়িত্ব এসে পরে হালিমা বেগমের উপর। তাই সংসার চালানো এবং ধার দেনা পরিশোধ করার জন্য কোন রোগীর সাথে হাসপাতালে গেলে দিনের কাজগুলো শেষ করে দুপুরের পর পাশের উপজেলা পবা ও গোদাগাড়ীর বিভিন্ন জায়গায় ছয় বছর ভিক্ষা করেছেন, স্বামীর ঔষধ এবং সংসার খরচ চালানোর জন্য। এখন ছেলে বড় হয়ে ঢাকায় তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছেন, পাশাপশি ধার দেনাও শোধ হয়েছে বলে আর তিনি ভিক্ষা করতে যান না। এ বিষয়ে হালিমা বেওয়া বলেন“ আমি জানতান ভিক্ষা করা খারাপ, কিন্তু কোন উপায় না পেয়ে আমি এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। এখন আমার আর কোন চিন্তা নেই। আমি যতদিন বাঁচব ততদিন এমনিভাবে আমার প্রতিবেশীদের সহযোগিতা করে যাব।”