কালের কীর্তিমান সাক্ষী সাটুরিয়ার “বালিয়াটি জমিদার বাড়ি”
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ থেকে
গোটা দেশে যে কয়েকটি প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম মানিকগঞ্জে সাটুরিয়ার বালিয়াটী জমিদার বাড়ি অন্যতম। জমিদার বাড়ি যা ”বালিয়াটী প্যালেস” নামে কালের কীর্তিমান সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে। শত বছরের পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়িটি বছর কয়েক আগেও জিন-ভুতের আড্ডাখানা ভাবতো এলাকাবাসউ। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করে ব্যাপক সংষ্কার করা হয়। প্রত্নত্তত্ব বিভাগের ছোঁয়ায় এখন তা নতুন সাঝে সজ্জিত হয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করছে। দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক এ বড়িতে ঢুকেই কারুকাজ দেখে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকেন। ভূয়সী প্রশংসা করেন সে আমলের নির্মাণ কারিগরদের।
জানা গেছে, এই দালানগুলো মধ্য ঊনবিংশ শতক থেকে বিংশ শতকের প্রথমভাগের বিভিন্ন সময়ে একটি ধনী পরিবারের কয়েকজন সদস্যের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন গোবিন্দ রাম সাহা। তিনি মূলত আঠারো শতকের শেষ দিকে একজন বর্ধিষ্ণু লবণ ব্যবসায়ী ছিলেন। গোবিন্দ রাম সাহার পরিবারের জমিদারির স্থায়িত্বকাল ১৭৯৩-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৫৭ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগেই জমিদারগণ এ বিশাল প্রাসাদ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। তাদের জমিদারী ২ ভাগে বিভক্ত ছিল যা দশ’আনি আর ছ’আনি অংশ নামে পরিচিত। দশ’আনি অংশের জমিদারবাড়ি বাংলাদেশ সরকারের প্রতœতত্ব বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে রয়েছে ৪টি বৃহদাকার সুদর্শন অট্টালিকা। প্রত্যেক অট্টালিকায় ঢুকার জন্য রয়েছে ভিন্ন চারটি ভিন্ন প্রবেশ দ্বার। প্রত্যেকটি দ্বারের ওপরে রয়েছে একটি করে সিংহ মূর্তি যা দেখলে জ্যান্ত মনে করে পর্যটকরা বিশেষ করে শিশুরা আতকে উঠে। চারদিকে সীমানা প্রাচীর ঘেরা প্রায় ২০ একর বাড়িটির ভিতরে আরও ৩টি ভবন রয়েছে। প্রত্যেক ভবনের ছাদে উঠার জন্য রয়েছে শাল আর সেগুন কাঠ দিয়ে বিশাল ব্যয়ে নির্মিত সিঁড়ি।
প্রাসাদের অট্টালিকা তিনতলা বিশিষ্ট হলেও উচ্চতায় বর্তমান সময়ের পাঁচতলা ভবনের সমান। সামনের চারটি ভবনের দ্বিতীয় ভবনে রয়েছে তাদের নির্মিত প্রমোদগার বা রংমহল। জমিদারদের ওই সময়ে ব্যবহৃত আসবাবপত্র দিয়ে এ কক্ষটি এখনো সাজানো রয়েছে। পর্যটকরা দেখেন অবাক বিষ্ময়ে। সাতটি ভবনের মধ্যে চারটি ছাড়া বাকী ভবনগুলো বসবাসের অনুপযোগী। বাড়ির ভিতরে রয়েছে মনোরম পরিবেশে আম, কাঠাঁল, বেল, লিচ, জাম্বুরা গাছসহ হরেক রকম ফল আর ফুলের গাছ।
বাড়ির সামনে দু’ঘাটলা বিশিষ্ট বিশাল পুকুর। সদর ঘাটলায় জমিদার বাহাদুর আর বিপরীত ঘাটলায় তার কর্মচারীরা ব্যবহার করতেন। একই ব্যবস্থা ৩ ঘাট বিশিষ্ট ভেতর বাড়ির পুকুরের বেলায়। সদর ঘাটলায় জমিদার রাণী আর উল্টো ঘাটে মহিলা কর্মচারীরা স্নান সারতেন। বাড়ির ভেতরে পুকুরের উল্টোদিকে রয়েছে সারিবদ্ধ প্রায় ৩০টি টয়লেট। এগুলো দেখলেই বুঝা যায় বর্তমান সময়ের কোন আবাসিক ভবন নির্মাণের চেয়েও ব্যয়বহুল্। সে আমলে কত টাকা ব্যয়ে এ প্রাসাদ নির্মাণ হয়েছে তা ধারণা করে বলা মুসকিল। প্রাসাদ তৈরি করেই ক্ষান্ত ছিলেন না জমিদাররা। এ প্রাসাদের পাশেই জমিদার বাবুর ভাগ্ন্ েঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে “ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর উচ্চ বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা তাদের আর এক নিদর্শন। এখানেই শেষ নয় রাজধানী ঢাকাতে “জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয়” আর হল নির্মাণ করেছিল জমিদার পিতা জগন্নাথের নামে।
কথা হয় স্থানীয় ৮০ বছরের বৃদ্ধ মমিন মিয়ার সাথে। তিনি জানান জমিদারদের আচরণের কথা। তাদের আমলে জুতা পায়ে আর ছাতা মাথায় নিয়ে যে কেউ এ বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে পারতো না। এতে নাকী বাবুদের অসম্মান হতো। এ নিয়ম অমান্য করলে তাকে প্রচন্ড শাস্তি পেতে হতো।
দেশের খ্যাতিমান পরিচালকদের চলচ্চিত্র, নাটক, টেলিফিল্ম, প্রামান্ন চিত্র নির্মাণের শুটিং করতে প্রায়ই দেখা যায় এ বাড়িতে। বাদ যায়নি জনপ্রিয় নির্মাতা হানিফ সংকেত এর ইত্যাদিও। ইতিহাসের নিদর্শন হিসেবে ২০১১ সালে পরিচালক হানিফ সংকেত “ইত্যাদি”র সবটুকু চিত্রায়নই এ প্রাসাদের সামনে করেন। তার শুটিংয়ের আলোক সজ্জায় প্রাণ ফিরে পেয়েছিল নিঃসঙ্গ প্রাসাদটি। যেন জমিদার বাহাদুর আবার প্রাসাদে ফিরে এসেছেন! কালজয়ী ছবি বেহুলা লক্ষিন্দর, জীবন সিমান্তেসহ অসংখ্য চলচিত্রের শুটিং হয়েছে এ বাড়িতে। শুটিং করতে ঢাকার আগারগাঁও প্রত্নতত্ব বিভাগের অফিসে অনুমতি নেন পরিচালকরা। এতে সরকারের প্রচুর রাজস্ব আয় হয়।
দেশী বিদেশী পর্যটকের ভীড় নিত্যদিনের ব্যাপার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, শিল্প কারখানার মালিক কর্মচারী এমনকি গার্মেন্টস কর্মীরাও দলবেধে পিকনিক করতে আসেন। জমিদার বাড়ির মুল ফটকের আঙিনা ঘেষে গড়ে উঠেছে বেশকিছু হোটেল-রেস্তোরা। বালিয়াটী প্রাসাদে ভ্রমণে এলে দর্শনার্থীরা প্রসংশা করে গাভীর দুধের তৈরি বিখ্যাত “ছানা সন্দেস” খেয়ে। এছাড়াও প্রাসাদের ফটকের বাইরে বসে হরেক রকম মুখরোচক খাবার ও প্রসাধনীর পসরা।
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি মানিকগঞ্জের গর্ব আখ্যায়িত করে সাটুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান বশির উদ্দিন ঠান্ডু জানান, ইতোমধ্যে সরকার বালিয়াটি জমিদার বাড়ি ব্যাপক সংষ্কার করে আধুনিকায়নের কাজ করেছে। এমনকি প্যালেজে যাওয়ার রাস্তা ঘাটেরও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে স্বল্প মূল্যের টিকেট ব্যবস্থায় দর্শনার্থীদের প্রবেশের ফলে সরকারের রাজস্ব আদায়ও হচ্ছে।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কালামপুর বা গোলড়া বাসষ্ট্যান্ড থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে মনোরম পরিবেশে এ প্রাসাদের অবস্থান। ঢাকার গাবতলী থেকে সাটুরিয়া যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৬০-৭০ টাকা। সাটুরিয়া পৌঁছে সেখান থেকে রিকশা বা লোকাল সিএনজিতে করে জমিদার বাড়ি যাওয়া যাবে। জনপ্রতি ভাড়া ১০টাকা। বালিয়াটি জমিদার বাড়ি রোববার পূর্ণদিবস আর সোমবার অর্ধদিবস বন্ধ থাকে। অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও বন্ধ থাকে। জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য টিকেটের মূল্য জনপ্রতি ১০টাকা।
# ছবি: আব্দুর রাজ্জাক