গর্ত খুরে জলাধার : বাগান ফসলের জন্য লোকায়ত সেচ পদ্ধতি আবিষ্কার
কলমাকান্দা, নেত্রকোণা থেকে গুঞ্জন রেমা
মানুষ নিজেকে সৃষ্টির সেরা জীব দাবি করে। কারণ মানুষ তার সক্ষমতার ভিত্তিতে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। যার জন্যই মানুষ তার বুদ্ধি ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক আবিষ্কার করে যাচ্ছে নিজ প্রয়োজনে। খুঁজে নিচ্ছে বেঁচে থাকার নানা কৌশল। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে সেটা আমরা জানি। আমরা এটাও জানি মানুষ এই জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে মোকাবিলা ও অভিযোজনও করে যাচ্ছে তার নিজস্ব বুদ্ধি, কর্মকৌশল, অত্যাধুনিক ও লোকায়িত জ্ঞান বা প্রযুক্তিকে অবলম্বন করে। তেমনই একটি অভিযোজনের লোকায়ত কৌশল আবিষ্কার করেছে কলমাকান্দার কিছু তরুণ।
কলমাকান্দা উপজেলার খারনৈ ও রংছাতি ইউনিয়নের মাঝামাঝি গ্রাম হলো পাতলাবন। পাশেই বটতলা ও আনচেংগ্রী গ্রাম। এই গ্রামের আবাদী জমিতে ভালো বা আবাদযোগ্য মাটির গভীরতা মাত্র ১-১.৫ ফুট। তারপর বালি আর বালি। প্রায় ১০-১৫ ফুট গভীরেও বালি পাওয়া যায়। কথিত আছে, আজ থেকে অনেক বছর আগে এখান দিয়েই নাকি মহাদেও বা মহাদেব নদীটি বয়ে গিয়েছিল। কোন এক কারণে নদীর গতি পথ পরিবর্তন হয়ে গেলে এই স্থানটি বালিময় পতিত জমিতে পরিণত হয়।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেখানে মানুষ বসবাস করা শুরু করে। আর বসবাসের প্রয়োজনেই মানুষ আস্তে আস্তে সেটি আবাদী জমিতে রূপান্তর করে নেয়। তবুও এই সব জমিতে এখনো অনেক বালি দেখা যায়। বালি থাকার কারণে এখাকার গ্রামের অধিকাংশ স্থানই শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে যায়; যা মরুভূমির মত রূপ নেয়। এমনকি জমিতে থাকা ঘাসগুলোও মরে যায়।
শুধু আমন মৌসুমে আবাদযোগ্য জতিতে আমন আবাদ করা যায়। আর যেগুলো পতিত থাকে সেসব স্থানটি জমির মালিক লিজ দেন গরুর ঘাস উৎপাদনের জন্য। এমনই একটি আপাত পতিত স্থানটি বটতলা গ্রামের বোরহান উদ্দিন লিজ নেন বর্ষা মৌসুমে গরুর ঘাস খাওয়ানোর জন্য। কারণ বর্ষা মৌসুমে গরুর খাদ্য ঘাসের চারণভূমিরও ব্যাপক সংকট দেখা দেয়। বোরহান উদ্দিন জানান, বর্ষা কালে ঘাস খাওয়ানো শেষ হলে বাকি সময়টুকু পতিত থাকে এই জমিগুলো। কোন কিছুই আবাদ করা হয় না।
পতিত থাকা এমন জমিতে দু’বছর যাবৎ শুকনো মৌসুমে লাউ বাগান করার চেষ্টা করছেন কয়েকজন। তাদেরই মধ্যে বোরহান উদ্দিন একজন। যিনি এবারই অন্যের দেখাদেখিতে লাউ বাগান করেছেন দুই ভাই মিলে। বোরহান উদ্দিন এবছর জে.এস.সি. (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষায় পাশ করেছে। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে তার বাবা ও বড় ভাইয়ের সাথে কৃষিকাজ করেন। বিভিন্ন শাকসব্জির বাগান করে যে টাকা আয় করেন সেটা কিছু টাকা নিজের জন্য রেখে বাদ বাকি বাবাকে দিয়ে দেন।
লাউ বাগান করেছেন কিন্তু সেচের জন্য কাছে কোন পানির উৎস নেই। থাকলেও অনেক দূরে তাই প্রথমে কষ্ট হতো সেচের জন্য। বাগানে সেচ দেওয়ার জন্য অন্যেরটা দেখে নিজেও লাউ এর মাঁচার নিচে ৫-৬ ফুট গভীর একটি বড় গর্ত খুরে পানির উৎস বানিয়ে নেন। এখনও সেই গর্তে যে পরিমাণ পানি আছে তা তার বাগানের জন্য যথেষ্ট। পানি সেচের জন্য অধিকাংশ কৃষকই এভাবে ৫-৬ ফুট গর্ত খনন করে পানির ব্যবস্থা করেন। মাঁচার নিচে পানি সেচের ব্যবস্থা করার ফলে সেচের জন্য তেমন কষ্ট করতে হচ্ছে না। তা নাহলে অনেক দূর থেকে পানি এনে সেচ দিতে হতো তাদের। যে কাজ টি করা কোন ভাবেই তাদের সম্ভব ছিল না। তাই এই সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করে কৃষিতে সেচ সুবিধা করে নিয়েছেন এখানকার কৃষকেরা।
বোরহান উদ্দিনের মত আরো ২৫ জন বালুযুক্ত আপাত পতিত জমিতে লাউ বাগান করেছেন। আবার সেচের জন্য লাউ এর মাচার নিচে গর্ত খুরে পানি সেচের ব্যবস্থা করেছেন সেটি জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনের কোন অংশে কম কি? জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনের জন্য বোরহান উদ্দিনের মত আরো অনেক কৃষক যারা কাজ করে যাচ্ছেন পাতলাবন, আনচেংগ্রী ও বটতলা গ্রামে। পাশাপাশি কিছু অর্থও আয় করছেন পতিত জমি থেকে। পতিত জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত একের পর এক কর্মকৌশল বদলে কাজ করছেন পাতলাবন, আনচেংগ্রী ও বটতলা গ্রামের তরুণ প্রজন্মের কৃষকেরা।