নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে প্রান্তিক মানুষের অধিকার শীর্ষক সংলাপে ‘মেয়রের মুখোমুখি’ তারুণ্য শক্তি
বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
“প্রায় ২৫০টি পরিবারের বসবাস আমাদের নামোভদ্রা বস্তীতে। পানির নেই কোন ব্যবস্থা। ল্যাট্রিন নেই। বিদ্যুতের খাম্বা, বিদ্যুতের লাইন ঘরের উপর দিয়ে চলে গেছে। তবুও আমরা বিদ্যুৎ পাইনা। গ্যাসতো আরও দুরের কথা। আমরা এই নগরির ভোটার। এই দেশের নাগরিক। নাগরিক হয়েও আমরা সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা সোলার প্যানেল পাইনা। পুকুরগুলো নষ্ট করা হয়েছে। আর গোসল করতে পারিনা। পানিহীনতায় জীবন যেন অচল। অন্ধকারে আমাদের নিরাত্তাও সংকটে। আমাদের জন্যে আলো চাই। বাঁচার জন্যে পানি চাই।”
জ্বালানিতে নগরের প্রান্তিক মানুষের অধিকার শীর্ষক নাগরিক সংলাপে কথাগুলো বলছিলেন নামোভদ্রা বস্তিবাসী রিকসা চালক মো. বাচ্চু মিয়া। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে বসবাস করেন গ্রীণসিটি রাজশাহীতে। কিন্তু নগরের আলোর নীচেই যেন অন্ধকারের হাহাকার অধীকারহীনতার গল্প শেষ হয় না। বুর্জুয়া সমাজ ব্যবস্থায় দিনে দিনে সকল অধিকার যেন উপরতলার আর্শীবাদ আর নীচের তলার মানুষগুলো আর্ত চিৎকার বেড়েই চলেছে। নিয়মনীতির সমতার অভাবে গরিব ও ভূমিহীন মানুষগুলো বিদ্যুৎ সংযোগ পায় না। নানা দিক থেকেই নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলো। অথচ তারা ভোট দিয়ে নেতা নির্বাচন করেন। একজন নাগরিক হিসেবে তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। বাঁচার দাগিদে রাষ্ট্রের ৫টি মৌলিক চাহিদার সাথে তাদেরও আশা পুরণ হবার কথা। কিন্তু হয় না!
রাষ্ট্রই মৌলিক অধিকার সুরক্ষা করে। আবার সেই রাষ্ট্রই কিছু নিয়মনিতি তৈরি করে প্রান্তিক মানুষগুলো সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। একজন প্রান্তিক কৃষক নিজের জমি নেই। এর ফলে তিনি ব্যাংকে ঋণ পান না। আবার বায়ু দূষণ, নদী দূষণসহ পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে ধনীরাই বেশি এগিয়ে। সব কিছুর বোঝা, কষ্ট যেন সইতে হয় প্রান্তিক মানুষগুলোকে। খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে। যারা রোদে পুড়ে আমাদের জন্যে প্রতি মূহুর্তের জন্যে খাদ্য উৎপাদন করে। উন্নয়নে অবদান রাখে। পরিবেশ সুরক্ষা করে চলে।
নগরের প্রান্তিক মানুষগুলো আরো বেশি সংকটে দিন পার করে। যারা শহরের বর্জ্য অপসারণসহ নানা নাগরিক সুবিধা সৃষ্টিতে অবদান রাখে অথচ তাদের জন্যে সুবিধাভোগী নাগরিক কি করে? প্রান্তিক মানুষের দুঃখ কষ্ট আর যন্ত্রণার মতোই নগরের না বলা প্রাণী ও উদ্ভিদগুলোরও কষ্ট আর সংকটের শেষ নেই। হরহামেশা দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ কর্তন, পাখি শিকার হচ্ছে। পাখির বাসস্থানও সংকটপূর্ণ। খাদ্য সংকটও প্রকট। সবই যেন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
কিন্তু তারুণ্য শক্তি কখনো শেষ হতে দেয় না তার সবুজ পরিবেশ। সবুজ নগরি এবং সবুজ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে আজকের তরুণ অনেকটাই সোচ্চার। নিজের পরিবেশ এবং প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্টায় তরুণরাই অগ্রগামী। সার্বিক দিকগুলো বিবেচনা করে রাজশাহীর তরুণ সংগঠনগুলো এগিয়ে আসছে। এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে জনমত ও সচেনতা তৈরির লক্ষ্যে নিয়ে সম্প্রতি ‘বৈষম্যহীন সবুজ রাজশাহীর প্রত্যয়ে তারুণ্য শক্তি’ শ্লোগানে রাজশাহীর নিরাপদ খাদ্য, নিরাপদ সড়ক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রান্তিক মানুষের জ্বালানিতে অধিকার শীর্ষক নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে নগরির উপশহরের ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিশন বাংলাদেশ মিলনায়তনে। তরুণরা ভুক্তভোগী মানুষগুলোকে সাথে নিয়ে, নগরের পরিবেশ সুরক্ষাসহ প্রান্তিক মানুষের জ্বালানি অধিকার বিষয়ে মেয়রের মুখোমুখি হন এই তারুণ্য শক্তি।
বারসিক, বরেন্দ্র শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা কেন্দ্রের যৌথ আয়োজনে উক্ত নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। রাজশাহীর ১৭টি তরুণ ও নাগরিক সংগঠনের নেতা, সরকারি, বেসরকারি ও নির্বাচিত প্রতিনিধি, সাংবাদিক, রাজশাহী শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিগণসহ নানা পেশার ৭০ জন নারী ও পুরুষ সংলাপে অংশগ্রহণ করেন। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মাদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল সংলাপে অংশগ্রহণ করে গ্রীনসিটি রাজশাহীর প্রান্তিক মানুষের নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অধিকারহীনতাসহ নাগরিক সমস্যাগুলো শুনে সেগুলো সমাধানে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান।
নাগরিক সংলাপে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল উত্থাপিত সমস্যাগুলোগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, “নামো ভদ্রা বস্তিতে পয়নিস্কাশন, ল্যাট্রিন, পরিবেশবান্ধব উন্নত চুলা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আগামীতে এই বস্তিবাসীরা যেন বিদ্যুৎ সুবিধা পান সে বিষয়ে নিয়মনীতির দিকগুলো নিয়ে আমরা নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে আলোচনা করবো।” তিনি নগরে প্রাকৃতিক জলাধার তথা ২৫টি পুকুর সংরক্ষণের জন্যে ২৯০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু করবেন বলে জানান। একই সাথে নগরের পরিবেশ সুরক্ষায় দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। বস্তিবাসীদের পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান। মেয়র রাজশাহী শহরে প্রান্তিক মানুষের জ্বালানি অধিকার নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন উদ্যোগ নিবেন বলে জানান।
সংলাপে রাজশাহীর প্রান্তিক মানুষের নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ক গবেষণা তথ্য উপস্থাপন করেন বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চল গবেষক ও আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মো. শহিদুল ইসলাম। গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থান করে তিনি বলেন, “রাজশাহীর প্রায় এক লাখের অধিক বস্তিবাসীর জ্বালানি অধিকার প্রায়ই নেই। শহরের নাগরিক হয়েও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।”
এছাড়া সংলাপে নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বর্তমান সংকট ও সমাধান বিষয়ে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তুলে ধরেন বরেন্দ্র শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা কেন্দ্রর (বিইসিডিপিসি) তরুণ শামীউল আলীম শাওন, জীবাশ্ম জ্বালানিহীন যাতায়াত ব্যবস্থাসহ সাইকেল লেন, হাটার জন্যে প্রশস্ত রাস্তার দাবিসহ নিরাপদ সড়ক বিষয়ে তথ্য উপস্থাপন করেন তরুণ মো. উজ্জল আহমেদ। নামো ভদ্রা বস্তিবাসী মো. সাজু মিয়া নিজের বস্তির পানি, বিদ্যুৎ, পয়নিষ্কাশন, শিক্ষাসহ নানা সমষ্যাগুলো তুলে ধরেন। তিনি বস্তিবাসীর নানান বঞ্চনা ও অধিকারহীনতা চিত্র তুলে ধরেন। এসময় নগরের প্রাকৃতিক জলাভূমি ও প্রান্তিক মানুষের পানির অধিকার শীর্ষক গবেষণা লব্ধ তথ্য উপস্থাপন করেন নদী ও পরিবেশ গবেষক মো. মাহবুব সিদ্দিক। তাঁর প্রবন্ধে তিনি স্থানীয় পুকুর ও জলাশয়গুলো রক্ষা নাজুক চিত্র তুলে ধরেন এবং এগুলো সংরক্ষণ ও সংস্কার করার আহ্বান জানান।
সংলাপে নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক অ্যাডভোকেড এনামুল হক বলেন, “শহরের তরল বর্জ্য বারনাই নদীতে পতিত হয়ে নদী দুষণসহ মানুষের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে।” সেভ দ্যা নেচার এর সভাপতি মো. মিজানুর রহমান বলেন, “নগরের দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে, নগরের শোভা বর্ধনে দেশীয় গাছের বদলে বিদেশি আগ্রাসী বৃক্ষ রোপণ করা হেেচ্ছ। যার ফলে পরিবেশের বন্ধু পাখির আহার ও বসবাসের উপযুক্ততা কমে যাচ্ছে।” তিনি নগরের প্রাচীন বৃক্ষগুলো রক্ষাসহ পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণার দাবি জানান। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র মোছা. নুরুন্নাহার বেগম বলেন, “বস্তিবাসীর নারীর স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে উন্নত চুলা সহযোগিতা করা হবে।”
নাগরিক সংলাপটি সঞ্চালনা করেন বারসিকের বরেন্দ্র অঞ্চল সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম। সমাপনী বক্তব্য দেন বারসিক রাজশাহী রিসোর্স সেন্টারের কর্মকর্তা জাহিদ আলী। বরেন্দ্র শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা কেন্দ্রের আহবায়ক জাওয়াদ আহমেদ রাফি উদ্বোধনী বক্তব্য দেন। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলসহ গ্রীনসিটি রাজশাহীর পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষায় তরুণদের উদ্যোগগুলো তুলে ধরেন। গ্রীনসিটি রাজশাহীকে সত্যিকার অর্থেই সকলের জন্যে গ্রীন করে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তরুণরা। নগরপিতা মেয়র মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল তরুণদের সাথে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।