আঞ্চলিক দুর্যোগ বিবেচনায় শস্যবীমার দাবি
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম:
আমাদের দেশের অর্থনীতিসহ খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান উৎস হলো কৃষি। সময়ের পরিক্রমায় কৃষি আর আগের মতো নেই। কৃষিতে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের যন্ত্র আবার জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি। তার পরও এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি উৎপাদন যা অর্থনীতির সূচকেও প্রতীয়মান হচ্ছে। আর এই অবদানে অনেক বড় ভূমিকা পালন করছেন আমাদের গ্রামের কৃষকরা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সামগ্রিক কৃষিতে উন্নয়ন হলেও কৃষকের নিজস্ব প্রত্যাশা ও চাহিদার বিষয়গুলি প্রায়ই উপেক্ষিত থাকছে।
প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণেই দিনে দিনে কৃষিতে দুর্যোগ বেড়েই চলেছে। ২০১৩ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমান সরকার ২০১৪ সালে কৃষিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনের লক্ষ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এর অনুদানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা কর্পোরেশন (এসবিসি) ও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) কর্তৃক রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্য বীমা চালু করেছে। যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষকদের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বাংলাদেশের জন্য এর মূল উদ্দেশ্যই হলো-আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবীমার মাধ্যমে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি হ্রাস করা। আবহাওয়া কেন্দ্র হতে প্রাপ্ত আবহাওয়া বিষয়ক সম্ভাব্য আগাম তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ বীমা পলিসি প্রস্তুত করা হয় এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই বীমা দাবি পরিশোধের বিধান রাখা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ধরনের শস্যবীমা অনেক আগে থেকেই প্রবর্তন করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও কৃষকদের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায়, রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে শস্যবীমা কর্মসূচীটি নিতে কৃষক পর্যায়ে নানা সচেতনতামূলক কর্মসুচী করাও হয়েছে। রাজশাহী জেলায় ৫ম পাইলটিং (২০১৭) এর আওতায় আমন ধানের অনুকূলে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবীমা পলিসি ইস্যুর কার্যক্রম হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে আবহাওয়া সূচক জানার জন্যে রাজশাহী জেলায় মোট ২০টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া কেন্দ্রও স্থাপন করা হয়েছে।
বর্তমান অবস্থায় মনে হয়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফসলের দুর্যোগ শুধুমাত্র আবহাওয়া সূচকে বিবেচনা করলে যথার্থ হবে না। ভৌগোলিক কারণেও এখানে নানা মাত্রায় দুর্যোগ হয়ে থাকে। আবহাওয়া তারতম্যজনিত কারণে ফসলে রোগ-পোকার আক্রমণ, নদী ভাঙ্গন, ভেজাল সার-বীজ ইত্যাদি কারণগুলোও বিবেচনা করা দরকার- যা অঞ্চলভেদেও ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমন উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চলে বন্যা না হলেও এখানে খরা, শীত-শৈত্য প্রবাহ, ফসলে রোগ-পোকার আক্রমণসহ মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ গুলো দেখা যায় বেশী। এ অঞ্চলে বর্তমান সময়ে কৃষি জমিতে পুকুর খনন করে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বিলের ফসল হানিও একটি মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এ অঞ্চলের কৃষকদের সাথে মতবিনিময় কালে জানা যায়, শস্যবীমা প্রাথমিকভাবে চালু হলেও অনেক কৃষকই এ বিষয়ে জানেন না। আবার যারা শস্যবীমার সুযোগ পেয়েছেন তাদের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কথা জানা যায়। সুবিধাভোগী কৃষকরা বলেন, “আবহাওয়াগত দুর্যোগ যখন হয় তখনই কেবল এই সুযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু অঞ্চলভিত্তিক দুর্যোগগুলো বিবেচনা করা হয় না।”
বিগত ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮ তারিখে রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি গ্রামের কৃষকদের সাথে মতবিনিময় কালে জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত কৃষক চাষী রহিমুদ্দিন বলেন, “বরেন্দ্র অঞ্চল আলাদা বৈশিষ্ট্যের একটি এলাকা, এখানে শস্য-ফসলের ধরনও কিছুটা আলাদা, আবার এখানে দেশের অন্যান্য এলাকার থেকে অনেক বেশী খরা দেখা দেয়। আবহাওয়া দুর্যোগের মাত্রাও এখানে অন্যরকম। খরার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো শস্যবীমার আওতায় আনা দরকার।”
মতবিনিময়ে অংশগ্রহণকারী কৃষকগণ নিজ এলাকায় শস্যবীমা কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য দাবি জানান। বীমা করার সময় কৃষকরা যে টাকা জমা দেন, সেই টাকার পুরোটাই ফেরত দেওয়ার নিয়ম রাখার দাবি করেন কৃষকগণ। মতবিনিময়ে উপস্থিত ছিলেন বড়গাছী দুঃস্থ মহিলা কল্যাণ সমিতির সভাপতি রহিমা বেগম, বড়গাছী কৃষক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল জব্বার ও বারসিক এর কর্মকর্তারা।
শস্যবীমা শুধুমাত্র কতিপয় আবহাওয়া সূচকভূক্ত দুর্যোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে স্থানীয় দুর্যোগগুলোও বিবেচনায় নেয়া দরকার। শস্যবীমার পাইলটিং কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি কর্মসূচি প্রণয়ন হবে এমনটিই প্রত্যাশা এ অঞ্চলের কৃষকদের। তাই এই দিকগুলো ভেবে দেখা দরকার।