প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় রিশিকুল খাড়ির ইজারা প্রত্যাহার
রাজশাহী শহিদুল ইসলাম শহিদ
প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় প্রত্যাহার হলো রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুল খাড়ির ইজারা। মানুষের মতামতকেই প্রধান্য দিতে হয়েছে সরকারকে। শত বছর ধরে এলাকার মানুষ খাড়িতে প্রবেশ করে আসছেন সমানভাবে। একসময় সরকার হঠাৎ করে সারাবছর পানি থাকে এমন স্থান প্রসাদপাড়া গ্রাম থেকে বিল ভর্তি মৌজা পর্যন্ত ইজারা ঘোষণা দেন। পাঁচটি ক্রোস ড্যাম নির্মিত প্রায় পাঁচ কিঃমিঃ খাড়ি, ইজারাটিতে উল্লেখ করা হয়। তবে চোখে পড়ার পর এলাকার জনসংগঠন ও সকল মানুষ এই ইজারা বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ইজারা বাতিল হয়। সরকারিভাবে খরা প্রবণ এলাকায় পানি ধরে রাখার জন্য বিগত ছয় বছর আগে খালের মুখে বরেন্দ্র অফিস কর্তৃক বাঁধ নির্মাণ করায় সেখানে সারাবছর পানি থাকে। আর সেই কারণে ভূগর্ভস্থ পানির চাহিদা কমিয়ে রবি মৌসমে খাড়ির পাড়ের জমিতে বেগুন, কফি, টমেটো, রসুন, পেঁয়াজ, গম, সরিষা, পালং ইত্যাদি ফসলে এ পানি ব্যবহার করেন। খাড়ি পাড়ের মানুষরা খাওয়ার পানি ছাড়া সকল ধরনের ব্যবহারিক পানি ও মাছের চাহিদা পূরণও করে আসছেন। ফলে নির্ভরশীলতার মাধ্যমেই বৈচিত্র্যময় পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষা করে চলেছে খাড়িটি।
দুই পাড়ের মানুষ ও গবাদি পশুর গোসলসহ গৃহস্থলে পানি ব্যবহারের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে অনেক ঘাট। এসব ঘাটে নারীরা গোসলসহ কাপড় কাচা ও বাসন ধোয়ার কাজে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে থাকেন। সবসময় সেখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির বোয়াল, বাইম, খরি, আইড়, পাতাশি, শোল, টাকি, পুটি, মাগুর শিং, রুই, মৃগেল, কাতলা, আইখড়, ফলি, ময়া, চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। শুধু মাছ নয়; এখানে কুইচ্যা, ব্যাঙ, সাপসহ হাজারো প্রাণীর আভাসস্থল। খাড়িতে দল বেঁধে এলাকার মানুষ মাছ ধরা উৎসবও পালন করে থাকেন। সেই মাছ সকলে ভাগ করে মিলেমিশে খান, এটি যেন এক সম্পৃতির বন্ধন। বর্ষার শুরুতে দুই পাড়ের বাঁশঝাড়ে হাজার হাজার বক, কক, পানকড়ি পাখি বাসা বাঁধে ও বংশ বিস্তার করে বর্ষা শেষে আবার চলে যায়। সেই সময় খাড়ির পাড় এলাকায় মনোরম এক পরিবেশ তৈরি হয়।
এই মনোরম পরিবেশ ধরে রাখতে চায় এই এলাকার মানুষ। এই লক্ষ্যে খাড়ির ইজারা বাতিল করার জন্য পার্শ¦বর্তী রিশিকুল, খড়িয়াকান্দি, কোশিয়া, আলোকছত্র, বিলদুবইল ও বাবুপুরসহ কয়েকটি গ্রামের মানুষ দল বেঁধে গণস্বাক্ষরসহ বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। আবেদনের আলোকে কর্তৃপক্ষ খাড়িটির উপর পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যবেক্ষণ শেষে সকল বিষয় বিবেচনা করে পুনরায় জন মানুষের জন্য পুনরায় খাড়িটি উন্মুক্ত করা হয়।
চাপাইনব্বাবগঞ্জের আমনুরা হয়ে গোদাগাড়ীর চান্নাই, শুগনা, মুশরা, পাকড়ী, বিল্লি, প্রসাদপাড়া, রিশিকুল, আলোকছত্র, খড়িয়াকান্দি হয়ে বিলদুবইল দিয়ে পার হয়েছে খাড়িটি। তানোর উপজেলার বারপিটা, বেলখড়িয়া, বাকশপুর, কাঠালপাড়া দিয়ে পবা উপজেলায় প্রবেশ করে জুয়াখালি নামে লদিকান্দা, কুপেরঘাট, বিলনেপালপাড়া হয়ে বাগধানী নামক স্থানে বারনই নদীতে মিলিত হয়েছে। নদীর সাথে সংযুক্ত থাকার ফলে জলজ প্রাণির বৈচিত্র্যতাও বেশি। আর এসব হাজারো বৈচিত্র্য প্রাকৃতিক নিয়মেই আন্তঃনির্ভশীলতার মাধ্যমে দির্ঘদিন টিকে থাকে এবং আছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. জালাল উদ্দিন বলেন,‘জনগণের উর্ধ্বে কেউ না, তাই খাড়ি ইজারা বাতির করে জনগণের পক্ষে রায় দেওয়া হয়েছে এবং ইউনিয়ন পরিষদে একটি সিদ্ধান্ত কপি পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রশাসন। এখন থেকে পূর্বের মত সকলের প্রবেশ অধিকার সমানভাবেই থাকবে।’
এলাকাবাসীরা জানান, খালের ভেতর তাদের নিজেদের জমিও ভাঙনের ফলে চলে গেছে। তবুও তাদের কোন অভিযোগ নেই। কারণ খাড়িটি প্রতিনিয়ত তাদের প্রাণের খোরাক যোগায়। তারা এই খাড়ির কোলেই সাঁতার কাটা শিখেছেন, তাদের সন্তানরা আজও সেখানে সাঁতার কেটে খেলা করে। তাদের মাঝে অনেকেরই নিজস্ব পুকুর নেই সেখান থেকে তারা মাছের চাহিদা পূরণ করে থাকেন। তাই খাড়িটি জনস্বার্থ বিবেচনা করে জনগণের হাতে ফিরে দেওয়ার ব্যবস্থা করায় স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারকে ধন্যবাদ জানান।