এ জীবনকে আমি ভালোবাসি
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
এক হাতে খেঁজুরের গুড় আর অন্য হাতে দু’টি নারকেল নিয়ে তারিতারি হাটছে রেবা, সামনে ভাঙ্গা বাঁশের সাঁকো পার হয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকাল হয়ে যাবে। তাই সন্ধ্যার আগেই পিঠার দোকানের চুলা জ্বালাতে হবে। শীতের সন্ধ্যা আর কুয়াশা ঘেরা সকালে ভাপা ও চিতই পিঠার ব্যবসা রেবা বেগমের। নেত্রকোনা পৌর এলাকার মইনপুর গ্রামের নিজ বাড়ির সামনে পিঠার দোকানটি। সামান্য পুঁজিতে বাড়ির সামনে একটি মুদির দোকান দিয়ে প্রথম সংসারের হাল ধরেন রেবা। শুধু শীত মৌসুমে তিনি পিঠা তৈরি করে বিক্রয় করেন। সদা হাসি মাখা মুখ রেবার। মুখের মিষ্টি হাসির জন্য চারপাশে অনেক দোকান থাকলেও গ্রামের লোকজন তাঁর দোকানে বসে পিঠা খেতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। তাই বিক্রিও ভালো হয়।
সদা হাসোজ্জ্বল এ নারীর জীবনের কিছু কথা আমাদের সেই সব মানুষের জন্য, যারা ছোট খাটো বিষয়ে অল্পতেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আজকাল খবরের কাগজ ও টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলে দেখা যায় চারদিকে শুধু হতাশার খবরাখবর। কেউ চাকরি না পাওয়ার জন্য হতাশ, কেউ পরীক্ষায় ভালো ফলাফল না পাওয়ার জন্য, কেউ ভালো বিয়ে হয়নি বলে, কেউ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়ার জন্য হতাশ। চারদিকে এমন হতাশার মাঝে জীবনে কিছু না পাওয়ার মধ্যেও এ সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায় সেই সব ব্যক্তি বা পরিবারগুলো আমাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে তেমনি বিশেষভাবে সক্ষম (প্রতিবন্ধি) একটি পরিবার রেবা বেগমের।
জন্ম থেকেই এক পা বাঁকানো রেবা বেগমের। দারিদ্রতার কারণে মায়ের গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন অপুষ্টির শিকার রেবা। দরিদ্র পিতা আব্দুর রহিম দিন মজুরের কাজ করে সংসার চালায়। দরিদ্র পিতার ঘরে একে তো মেয়ে তার উপর এক পা পঙ্গু! এ যেন মরার উপর খারার ঘা। পঙ্গু পা হলেও রেবা ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় খুব ভালো। নিজের আগ্রহে প্রায় ২ কিলোমিটার দুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ছেলে বেলা থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারের সকল কাজে দক্ষ হয়ে উঠেছে রেবা।
শারীরিক সমস্যা তার পিছু টেনে না ধরলেও সমাজ ও দারিদ্রতা তার জীবনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়েকে কারো হাতে তুলে দিতে পারলেই যেন সমাজের বোঝা কমে যায়। পুতুল খেলার বয়সে মাত্র ৪র্থ শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় রেবার বিয়ে ঠিক হয়। পুতুলের বিয়ে নিয়ে যেমন খুশি হয় ঠিক তেমনি খুশি হয় রেবা নিজেও। বিয়ে মানে রেবার মনে তখন নতুন শাড়ী, নতুন নতুন সাজের জিনিসের স্বপ্ন। বিয়ের দিন ঠিক করার পর জানতে পারে তার মত এক পা পঙ্গু মেয়ের জন্য যে পাত্র ঠিক করা হয়েছে সে একজন শ্রমিক। নেত্রকোনার বিভিন্ন বাজারে কুলির কাজ করে। পাত্রের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন বাক্ প্রতিবন্ধী।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম দেয় রেবা। গর্ভবতী মায়ের যত্ন সম্পর্কে কোন ধরনের ধারণা না থাকায় প্রতিবন্ধী এক ছেলে সন্তানের জন্ম দেয় রেবা। বাল্য বিবাহ, বাক প্রতিবন্ধী স্বামী, নিজের শারীরিক অক্ষমতা কোন কিছু তার জীবনে হতাশা বয়ে না আনলেও প্রতিবন্ধী এ সন্তান যেন স্বাভাবিক জীবনের মোড়কে অন্যদিকে বদলে দেয়। স্বামীর পরিশ্রমের সমস্ত টাকা দিয়ে ছেলের চিকিৎসা করায় কিন্তু কোন কিছুই কাজ হয় না। এভাবে সংসার জীবনের সাথে সংগ্রাম করে করে আজ রেবা আজ ৩৫ বছর বয়সে পর্দাপন করেছেন। এরই মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সন্তানের মা হয়েছেন। বড় মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। দিনমজুর বাক্ প্রতিবন্ধী স্বামী এখন আর কায়িক পরিশ্রম করতে পারেনা। সন্তানসহ পরিবারের সকলের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বর্তেছে এখন রেবার উপর। পরিবারের ৪জন সদস্যের মধ্যে ৩জনই শারীরিকভাবে অক্ষম (ছোট মেয়েটি ছাড়া)। বর্তমান সরকারে সামাজিক পরিসেবার আওতায় বড় ছেলের জন্য স্থানীয় সরকার থেকে একটি প্রতিবন্ধী কার্ড পেয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতি মাসে ৩০০ শত টাকা ভাতা পায়। এ সাহায্যও আবার প্রতি তিন মাস মাস পর পর পেয়ে থাকে। যদিও এ সাহায্য তার প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য খুবই সামান্য। এ নিয়ে রেবা বেগমের কোন আক্ষেপ নেই এ সম্পর্কে বলেন, “কে কি দিল এ নিয়ে আমি ভাবি না আমার এ পায়ে যতক্ষণ জোর আছে আমি একাই হাঁটব, কিছু পাই না পাই এ জীবনকে আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি এ দেশকে।”
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বারসিকের উদ্যোগে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ও বাল্য বিবাহের কুফল নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে গর্ভবতী মা ও নারী, কিশোরী স্বাস্থ্য সেবা বিষয় সম্পর্কে রেবা বেগমের মধ্যে এখন সচেতনতা বেড়েছে। এ নিয়ে নিয়ে তার ছোট দোকান ও পিঠার বিক্রয়ের সাথে সাথে গ্রামের নারীদের স্বাস্থ্য সেবা ও টিকা দেওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে নিজেই আলোচনা করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি এবং আমার মা স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা ছিল না যার ফলে আমরা বাল্য বিবাহের শিকার এর জন্য আজ আমি সারাজীবনে এ সমস্যা ভুগছি, আমি মনে করি প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে প্রতিটি নারী ও কিশোরীদের পরিষ্কার ধারণা ধাকা প্রয়োজন। আমি আমার জীবনের ইতিহাস বদলাতে পারব না কিন্তু নতুন যারা আছে আমি চাই সবাই সচেতন হোক।”
হাজার না পাওয়ার মধ্যে এ পৃথিবীর যে মানুষগুলো সংগ্রাম করে বেঁচে আছে তাদের শক্তি আমাদের নতুন প্রজন্মেকে তাদের জীবনকে ভালোবাসতে শিক্ষা দেয়। এ ধরনের পরিবাররগুলোর প্রতি সমাজের সকল স্তরের মানুষের যেমন না পাওয়ার মধ্যেও জীবনে বেঁচে থাকার শিক্ষা নেওয়া উচিত তেমনি করুণা নয়; সকলের শ্রদ্ধাভরে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত!