বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পল্লী, কৃষি ও কৃষক উন্নয়ন চিন্তা
ঢাকা থেকে কাজী সুফিয়া আখ্তার
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য ভান্ডার বিশাল, সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। তাঁর সাহিত্য জীবন ষাট বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাপ্ত ছিল। এবং সাহিত্যকর্মের মান বরাবরই ছিল উর্দ্ধমুখী। তাঁর সাহিত্যের মূল বিষয় মানুষ। মানুষের সাথে মানুষের, সমাজের, প্রকৃতির, বিশ্বজগতের সম্পর্কটাই সেখানে মুখ্য। তাঁর ছোটো গল্পে গ্রামবাংলার জীবনযাত্রা বিধৃত হয়েছে গভীর মমতায়, পরম বিশ্বস্ততায়। একান্ত কাছ থেকে দেখার আন্তরিকতায়।
লেখালেখির সমান্তরালে তিনি ছিলেন কর্মযোগী, উদ্যামী, কাজ পাগল অনুকরণ ও অনুসরণযোয্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন ধন বৈষম্যের বিরুদ্ধে অসাধারণ মানবিক মানুষ। বালক বয়স থেকেই পিতার সাথে জমিদারি পরগণার বিভিন্ন স্থানে গেছেন। কলকাতায় জামিদারি কাছারিতে বসে নানা রকমের কাজসহ অনেক হিসেব – নিকেশের শিখেছেন। পিতার আদেশে ১৯৮৩ সাল থেকে প্রায়ই পূর্ববঙ্গে আসতেন জমিদারি রক্ষার কাজে। থাকতেন পদ্মা বা অন্যকোনো বোটে অথবা কুঠিবাড়িতে। উনিশ শতকের শেষ দশকে অর্থাৎ ১৮৯১ সালে তিনি যখন নিজেদের জমিদারি দেখাশোনা করতে সপরিবারে পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন, শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে থাকতেন, তখন কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মের সূচনা হয়। সেই সময়ে শুধু নয়, বর্তমান সময়েও তাঁর মত কোনো প্রখ্যাত সাহিত্যিক পল্লী ও কৃষক উন্নয়ন, সমবায়, কৃষি কিংবা গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করেননি। স্বচিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে এমন বদ্ধপরিকর হয়ে এগিয়ে আসেননি। গ্রামীণ মানুষের মধ্যে সমষ্টিগত কর্মপ্রচেষ্টা জাগিয়ে পল্লী বা গ্রামকে সার্বিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর করতে উদ্যোগী হননি। এই অঞ্চলে তাঁদের ছিল তিনটি পরগনা। নদিয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার বিরাহিমপুর, কাছারি ছিল শিলাইদহে, পদ্মার ওপারে; পাবনা জেলার সদর মহকুমার সাজাদপুর, এই নামের খালের ধারে সাজাদপুর গ্রামে ছিল কাছারি; রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমার কালিগ্রামে, কাছারি ছিল চলনবিলের কাছে নাগর নদীর ওপরে পতিসরে। কবি থাকেন পদ্মা কিংবা অন্য কোনো বোটে অথবা কুঠিবাড়িতে। পূর্ববাংলার প্রকৃতি তাঁকে মুগ্ধ করেছিল,অভিভূত করেছিল। তিনি নিত্যদিন বোটের জানালা দিয়ে, কখনো নৌকোর ছাদে বসে প্রকৃতিকে দেখেছেন, সকাল সন্ধ্যার রূপ দেখেছেন, বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টি উপভোগ করেছেন, নদীর শান্ত ও উন্মত্ত রূপ এবং নদীর দু‘ধারের বসবাসকারী খেটে খাওয়া মানুষদের দেখেছেন। দেখেছেন জোড় হাত করে সম্ভ্রমে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ানো প্রজাদের, যারা বেশির ভাগই ছিলেন কৃষক। তিনি তন্ন তন্ন করে খুঁজছেন গ্রামের মানুষদের, বিশেষ করে কৃষকদের সমস্যার স্বরূপ।
জাতীয় চেতনা, দেশপ্রেম, স্বদেশ চেতনা, কৃষক ও কৃষি উন্নয়ন চিন্তা ছিল কবির সর্ব কর্মের, আনন্দের ভিত্তি। তাঁর চিন্তাভাবনার মধ্যে নিজ থেকে উদ্যোগ গ্রহণের এবং আত্মশক্তি বাড়ানোর উপর জোর দেয়া হয়েছে। তিনি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন যারা বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের ক্ষুধার অন্ন জোগায়, তারাই থাকেন অর্ধাহরে, অনাহারে। তারা মহাজনের কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ প্রদানের অঙ্গীকারে টাকা কর্জ নেন এবং সারাজীবনের জন্য মহাজনের ঋণের ফাঁদে অর্ধমৃত মানুষের মত ধরা পড়েন। তাদের কোন সম্মান নেই। কৃষকেরাও তাদের অন্তর্নিহিত শক্তির সন্ধান জানেন না। তাদের আত্মবিশ্বাসও কম। মহাজনদের হাত থেকে গরীব কৃষক ও ভাগ চাষিদের রক্ষা করতে তিনি আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে শিলাইদহে প্রথম অল্প সুদে কৃষকদের মধ্যে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করেন। কৃষকের জীবনের বহু আকাক্সিক্ষত ঋণমুক্তির স্বপ্ন সফল হল কবির প্রিয় গ্রাম শিলাইদহে। মহাজনেরা পাততাড়ি গুটিয়ে অন্যত্র চলে যায়। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে ও সাজাদপুরে একই উদ্দেশ্যে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। কালিগ্রাম পরগণার আশি ভাগ প্রজা ছিল মুসলমান। কৃষি তাদের একমাত্র পেশা। বছরে একটিমাত্র ফসল হতো। আগাম বর্ষার ফলে সেই ফসল নষ্ট হলে কৃষকদের দুর্দশার সীমা, পরিসীমা ছিল না। মহাজনদের হাত থেকে কৃষকদের বাঁচাতে তিনি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন তাঁর নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূলধন হিসেবে প্রদান করে। এই কর্মের সূফলও পাওয়া গেল। ‘কৃষি ব্যাংক থেকে কর্জ নেবার চাহিদা খুব বৃদ্ধি পেয়েছে। কালীগ্রাম পরগণার মধ্যে বাইরের মহাজনরা তাদের কারবার গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।…ব্যাংক খোলার পর বহু গরিব প্রজা প্রথম সুযোগ পেল ঋণমুক্ত হবার।’
শিলাইদহের সেই সময়ের কৃষক প্রজা ‘কফিলুদ্দীন – জামালুদ্দীন শেখের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ধানখেতের পোকা মারার পদ্ধতি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন। তিনি যান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধে ছিলেন আজীবন। কিন্তু যন্ত্র দিয়ে চাষের প্রবর্তন করেছিলেন ফলন ভালো হওয়ার জন্য। কলের লাঙলের এনেছিলেন। উন্নতমানের বীজ ও সার যাতে কৃষকেরা সময় মতো ও ঠিক মতো পায় সেদিকে নজর দিয়েছিলেন। বাইরে থেকে বাঁধাকপি, সীম,আখ এনে কৃষকদের চাষে উৎসাহিত করেন।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা বিষয়ক চিন্তাভাবনাও শুরু হয় শিলাইদহে। শিক্ষা যে গরীব, ধনী, কৃষক, প্রজা জমিদার সকলের জন্য প্রয়োজন এই উপলব্ধি গভীরভাবে অনুভব করে ছিলেন। প্রথমদিকে এমনও হয়েছে, তিনি তাদের বিদ্যালয় তৈরির জন্য জমি দিয়েছিলেন। বিদ্যালয়ও তৈরি হয়েছে। কিন্তু পড়ুয়া পাওয়া গেল না। পরে পাশের গ্রামের মানুষ বিদ্যালয়ের ঘরটি চেয়ে নিয়ে তারা স্কুল চালালো। সাজাদপুরে শিক্ষার আলো ছড়ানোর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ পল্লীর মানুষদের অজ্ঞতা, কুসংস্কার দূর করে আলোর পথে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ঠাকুর এস্টেটের অর্থানুকূলে সেখানে একটি ইংলিশ স্কুল আগেই গড়ে উঠেছিল। জলকষ্ট নিবারণের জন্যে প্রজারা কুয়ো খুঁড়লে তিনি নিজের খরচে তা পাকা করে বাঁধিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন।
পল্লীবাসীরা যে উপেক্ষিত,অবহেলিত এটা রবীন্দ্রনাথকে পীড়া দিতো।‘যতক্ষণ দেশকে না জানি,যতক্ষণ তাকে নিজের শক্তিতে জয় না করি, ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয়।’(দেশের কাজ)। তিনি ছিলেন ধন বৈষম্যের বিরুদ্ধে, জাত বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ‘নিজের পাঠশালা, শিল্পশিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্য ভান্ডার ও ব্যাংক স্থাপনের জন্য পল্লীবাসীদের শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করতে হবে। এমনি করে দেশের পল্লীগুলো আত্মনির্ভরশীল ও ব্যূহবদ্ধ হয়ে উঠলেই আমরা রক্ষা পাব।’(সমবায় নীতি)। মূলতঃ তাঁর পল্লী, কৃষি ও কৃষক উন্নয়নের চিন্তা ছিল বহুমুখী সমন্বিত উদ্যোগ, যা ছিল একসূত্রে বাঁধা। সে কারণে তিনি প্রজাদের, কৃষকদের সমবায়ে উৎসাহিত করেন এবং তাদের আত্মশক্তি বাড়াতে হিতৈষী সভা গঠন করেন। কৃষির উন্নতি ও কুটিরশিল্পের সমবায় সংগঠনের রূপরেখা তিনি রচনা করেই ক্ষান্ত হননি, বাস্তবে প্রয়োগ করেছেন কৃষকদের সাথে নিয়ে। তিনি কৃষক প্রজাদের বলেছেন, ‘যাহা একজনে না পারে তাহা পঞ্চাশজনে জোট বাঁধিলেই হইতে পারে। তোমরা যে পঞ্চাশজনে চিরকাল পাশাপাশি পৃথক পৃথক চাষ করিয়া আসিতেছ, তোমরা তোমাদের সমস্ত জমি হাল লাঙল গোলাঘর পরিশ্রম একত্র করিতে পারিলেই গরিব হইয়াও বড়ো মূলধনের সুযোগ আপনি পাইবে।’
অন্যদিকে,তিনি জমিদারি কাছারির কর্মচারিদের সাথে কৃষক ও প্রজাদের দূরত্ব কমিয়ে এনে সৌর্হাদ্য স্থাপন ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে এক কর্মচারীকে খাজনা ও কর আদায়ে দরিদ্র কৃষকদের প্রতি মানবিক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এক পত্রে লিখেছেন, ‘প্রজাদের অবস্থা ও উৎপন্ন ফসলের পরিমাণের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াই আদায় তহশীল করা শ্রেয়।’ কর্মচারিরা অন্যায় করলে এবং বিভিন্ন সময়ে গ্রামের মানুষ ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়ে মামলা মোকদমা করতে যাতে শহরে ছুটে আদালতে না যায়, সে লক্ষ্যে তিনি বিরাহিমপুর ও কালীগ্রাম পরগণাতে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে এক একটি বিচার সভা স্থাপন করেন। সমস্ত পরগণার জন্যে পাঁচজন সভ্য নিয়ে এই বিচার সভা। এই সকল কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে কৃষক প্রজাদের সঙ্গে তাঁর একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। শেষবার, মৃত্যুর ৪ বছর আগে তিনি যখন পতিসরে গিয়েছিলেন, তাঁকে বিদায় জানাতে নদীর পাড় দিয়ে তারা দল বেঁধে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছিলেন। শেষের দিকে জমিদারের কাছারিতে হিন্দু মুসলমান প্রজাদের বসবার স্থান একই করেছিলেন। জাজিমের কোন অংশ তোলা থাকতো না। হুকোর জলও ফেলা হতো না। সর্বজনের সার্বিক সমুন্নতি ছিল তাঁর নিয়ত চিন্তা। তাঁর চিন্তাধারা এখনো অনেক গুরুত্ব বহন করে। আমাদেরকে উন্নয়নের কাজে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে।
পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ-পতিসর-পদ্মা -আত্রেয়ী-নাগর যে তাঁর মনোভূমিতে এইসব কাজের বীজতলা তৈরির কাজ করেছে, এ কথা কবি স্বয়ং শ্রদ্ধার সঙ্গে ও মানবিক কর্তব্যবোধের সঙ্গে একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন। তাঁর কাছে আছে আমাদের জ্ঞান ও চিন্তার অপরিশোধ্য ঋণ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭তম জন্মদিনে তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।