বাংলার ফল কাউফল
:: দেবদাস মজুমদার, বিশেষ প্রতিনিধি, উপকূলীয় অঞ্চল::
গাঢ় চিরসবুজ ঘনপাতায় ঠাসা নিসর্গের বৃক্ষরাজি। চিরসবুজ গাছ একাই বুনোঝোপের মত দাড়িয়ে থাকে। সবুজ কাচা আর হলুদ পাকা ফলের থোকায় আরও শোভন হয় বৃক্ষ প্রাণ। ঘন পাতার ঝোঁপে পাখির নিরাপদ আশ্রয় । তবে কাউফল টক ফল বলে পাখিরা ফলে আসক্ত নয়। কিন্তু মানুষ খায় মহা তৃপ্তি ভরে। গাছের ফল ঠিক গোখাদ্য না হলেও সাধারনত কাউফল নামেই এর পরিচিতি। তবে অঞ্চল ভেদে এ ফলের নামের ভিন্নতা আছে। পিরোজপুর ও ঝালকাঠি অঞ্চলে এর পরিচিতি কাউফল নামেই। এছাড়া কুমিল্লায় বলে শুধু কাউ,সিলেট মৌলভী বাজারে কাউয়া,বাগেরহাট অঞ্চলে এর পরিচিতি ক্যাফল নামে। আদিবাসী মানুষের কাছে এর পরিচিতি আবার অন্য। চাকমারা চেনে কাউ-গোলা,মারমারা চেনে কাগলিচু অথবা তাহগালা নামে। ছেলে বেলা যার গায়ে কেটেছে তারা নিশ্চয়ই কাউফলের স্বাদ নিয়েছে। তবে কাউফলের পরিকল্পিত আবাদ না থাকায় বাংলার ফল ভা-ার থেকে কাউফল বিলুপ্তির দিকে। অনেকে তাই স্মৃতি থেকে হারিয়ে ফেলেছেন। আগামী ১০/১৫ বছরের মধ্যে কাউফলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে বলে নিসর্গ ও বনবিদরা মনে করেন।
কাউফলের ইংরেজী নাম Cowa (mangosteen),বৈজ্ঞানিক নাম Garcicnia cowa।
[su_custom_gallery source=”media: 7″]নামের ভিন্নতা যাই হোক কাউফল গাছ বেশী মোটা নয় মাঝারী আকারের বৃক্ষ। গাছের রং অন্য বৃক্ষের চেয়ে কিছুটা কালো । ডালপালা ছড়ায় কম। গাছে উপড়ের দিকে অনেকটা ঝুপড়ির মত থাকে। থোকা ফল ধরে। ফল কাঁচা অবস্থায় গাঢ় সবুজ বর্ণের। পাকা ফল উজ্জল হলুদ ও কিছুটা কমলা রঙের মিশেলেও হয়। পাকা ফলের ভেতর কমলার মত ৪/৫টি দানার মত হয়। পাকলে ফলের দানা(কোয়া)চুষে খাওয়া যায়। ফলের স্বাদ একেবারেই টক । তবে চুষতে চুষতে কিছুটা মিষ্টতার স্বাদও মেলে। কাউফল অরুচি দুর করে। এ ছাড়া ঠান্ডাজনিত স্বর্দিজ্বর প্রশমনে কাউফল বেশ উপকারী বনাজি।
বন ও কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানাগেছে, সারাদেশে অল্পবিস্তর কাউফলের দেখা মেলে। তবে সিলেট,মৌলভী বাজার, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে কাউফলের দেখা মেলে বেশী। পিরোজপুর ও বাগেরহাট অঞ্চলেও এ ফল জন্মে। অনেক গৃহস্থ বাড়ির লোকজন শখ করেও দুই একটি গাছ লাগায়। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে নার্সারীতে কাউফলের চারা উৎপাদনও করা হয়। তবে এর বানিজ্যিক আবাদ নেই। কাউফলের চাহিদা রয়েছে বাজারে। পাকা কাউফল কেজি প্রতি ৭০/ ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
উপকূলে কাউফল গাছ এখন আর তেমন দেখা মেলেনা। তবে ঝালকাঠির শতদশকাঠি গ্রামের নার্সারী মালিক সরোজিৎ হালদারের বাড়িতে দুইটি কাউফল গাছের দেখা মেলে সম্প্রতি। তিনি শখ করেই এ গাছ দুটি তার বসতঘরের পাশে পুকুর পাড়ে লাগিয়েছেন। তিনি জানান,কাউফল চাষে কোন আর্থিক খরচ নেই। এর তেমন কোন পরিচর্যাও দরকার পড়েনা। প্রতিবছর মাঘ-ফাল্গুন মাসে এ গাছে মুকুল ধরে। ফল পরিপক্ক হয়ে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে পাকে। প্রতিবার গাছে দুই থেকে আড়াই মন ফল উৎপাদন হয়। ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বাজারে কাউফল বিক্রি হয়। কাউফল অর্থকরী ফল। এর পরিকল্পিত আবাদ প্রয়োজন।
বরগুনার বামনা উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইদুর রহমান মানিক জানান, কাউফল গাছ বেশ শক্ত গাছ। কাউফল বনাজি ফল। মানবদেহের জন্য উপকারী আবার এ গাছের ঘন পাতার ঝোঁপ পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়। আবাদ নেই বলে কাউফল গাছ আমাদের বন বৈচিত্র্য থেকে হারিয়ে গেছে। মানুষের সচেতনতা ছাড়া কাউফল গাছ টিকিয়ে রাখা কঠিন।
এ ব্যাপারে উপকূলীয় বন বিভাগ পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো জানান,কাউফল আমাদের নিজস্ব বৃক্ষ প্রজাতি। এক সময় গ্রামীণ বৃক্ষ প্রজাতি হিসেবে এর পরিচিতি ছিল। আমাদের জীব বৈচিত্র্য সুরক্ষায় কাউফল গাছের গুরুত্ব রয়েছে। তবে কাউফল গাছ এখন প্রায় বিলুপ্ত। আগামী ১০/ ১৫বছরের মধ্যে এ গাছ হারিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। কাউফল গাছ আমাদের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার জন্য সহায়ক। এ গাছের আবাদ সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ প্রয়োজন। বন বিভাগ ও স্থানীয় জনমানুষের সম্মিলিত উদ্যোগে এই নিসর্গ প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।