কৃষকের বন্ধু পাখি
হরিরামপুর মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
খাল-বিল-নদী মিলে গঠিত মানিকগঞ্জ জেলা। মানিকগঞ্জ জেলার ৭টি উপজেলার মাটি-পানি ও পরিবেশ উপযোগী হওয়ায় প্রাকৃতিক-প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর। বিশেষ করে হরিরামপুর, শিবালয় ও দৌলতপুর উপজেলার উপর দিয়ে পদ্মা নদীর বয়ে যাওয়ার ফলে ফসলী জমিতে প্রচুর পলি পড়ে মাটিকে উর্বর করে তুলে। মাটি উর্বর থাকায় কৃষকরা নানান রকম ফসল ফলাতে পারেন। এই ফসলবৈচিত্র্য একদিকে যেমন মানুষের খাদ্যের যোগান দেয় অন্যদিকে এ ফসলগুলো পাখিরও খাদ্যের উৎস। পাখিরা সহজে খাবার যোগাড় করতে পারে বলে এখানে নানান রকম পাখির অস্তিত্ব চোখে পড়ে। হরিরামপুরের চর ও গোপিনাথপুর বিল এলাকা থেকে তথ্য নিয়ে জানা যায়, এলাকায় যে পাখিগুলোর বিচরণ দেখা যায়, সেগুলো হলো, চখা, সরালী, বালিহাঁস, দুখনি, শামুভাঙ্গা, সাদা বক, কানা বক, গো বক, ময়না, ফেচুয়া, চড়াই, সাড়ুক, ঘুঘু, ওয়াক পাখি, নাইরুলি, মানিকজোড়, পানি কাউর, শালিক, হটিটি, টিয়াপাখি, জালালী কবুতর, ডুবের পাখি অন্যতম। এছাড়াও হরিরামপুর উপজেলা পদ্মা নদী দ্বারা বেষ্টিত হওয়ার শীত মৌসুমে পদ্মা নদীর চরে ও দিয়াবাড়ী বিল, গোপিনাথপুর বিল, ভাতচালা বিল, পিপুলিয়া চকে বিভিন্ন দেশী ও অতিথি পাখির বিচরণ দেখা যায়। এসব পাখিগুলো দল বেঁধে দিনের বেলায় তারা খাল, বিলে, পদ্মা নদীর জেগে উঠা চরে ও কৃষকের জমিতে শস্য মাঠে পোকা খাবার খেতে আসে। অধিকাংশ পাখিই গাছে বাসা বাঁধে এবং কবুতর মানুষের তৈরিকৃত বাসায় থাকে।
তবে উন্মুক্ত ও স্বাধীনভাবে এসব পাখি চলাচল ও স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছেনা ইদানীং। পাখির এ অবাধ বিচরণকে কিছু মানুষ ভালো চোখে দেখে না। তাই তাদের শখ মিটানোর জন্য তারা এসব পাখি শিকার করে। মানিকগঞ্জ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের পাখির বিচরণ থাকায় আগে থেকেই বিভিন্ন এলাকার (ঢাকা, মানিকগঞ্জ, সিংগাইর, সাভার) লোকজন শখের বসে এয়ারগান নিয়ে পাখি মারতে আসে। এছাড়া এলাকার কিছু মানুষ চর এলাকায় নেটজাল দিয়ে পাখি শিকার করেন। বড়দের পাখি শিকার দেখে ছোটদের সাধ জাগে পাখি মারার। তাই তারা হাতে তৈরি কাঠের কেটি এবং রাবারের বাটুল দিয়ে পাখি শিকার করে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তো দলবল নিয়ে পাখি শিকার করেনই। এটা তাদের শখ! পাখি শিকারের কারণে এলাকায় পাখির বিচরণ যেমন কমেছে ঠিক তেমনি পরিবেশ ভারসাম্যও নষ্ট হয়েছে বলে দাবি করেন এলাকার কৃষকরা। এই প্রসঙ্গে হরিরামপুরের ভাটি পাড়ার নানু সরদার (৪৫) বলেন, “পাখি কৃষকের বন্ধু, ফসল উৎপাদনের সহযোগী, প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে, পাখি আছে বলেই আমরা চাষাবাদ করে ফসল ফলাতে পারি, উৎপাদিত ফসল গড়ে তুলতে পারি।” তিনি বলেন, “আমার জমিতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি বসে, পোকা খায় ফসল ফলাতে সহযোগিতা করে। কৃষকের সব চেয়ে বড় বন্ধু পাখি, কেউ পাখি মারতে আসলে আমার কাছে খুবই খারাপ লাগে, বলি পাখি মাইরবানা, বাড়ি চলে যাও।” তিনি আরও বলেন, “অনেক অফিসার (পেন্ট পড়া) লোকজন পাখি মারতে আসে তাদেরকে কিছুই বলি না, বলার প্রয়োজন। তবে প্রতিজ্ঞা করছি এখন থেকে কাউকে আমাদের এলাকা থেকে পাখি মারতে দিব না।”
মানিকগঞ্জ এলাকায় পাখি শিকার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের প্রচার এবং সচেনতা তৈরির উদ্যোগের কারণে সরকারি-বেসরকারি ও বিভিন্ন সচেতনমহলের নজরে আসে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন মহলের সহযোগিতা নিয়ে বারসিক পাখি শিকার বন্ধে এবং পাখি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য হরিরামপুর উপজেলা ১৩টি ইউনিয়নের খাল-বিল-নদী ও বিচরণ এলাকা এবং জনসম্পৃক্ত স্থানে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে বিল বোর্ড স্থাপন, পোস্টার পেপার ও লিফলেট বিতরণ করে। বিলবোর্ডসহ অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে যেসব তথ্য উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘দেশীয় ও অথিতি পাখি হত্যা দন্ডনীয় অপরাধ, পাখি পরিবেশ সংরক্ষণ করে ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে, বন্যপ্রণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ মোতাবেক পাখি মারা/হত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণ ও নিরাপদ বসবাসের সুযোগ দিন, পাখি আমাদের উপকারী বন্ধু, পখিকে বাঁচতে দিন, রক্ষায় সচেতন হউন’ ইত্যাদি। বিলবোর্ড দেওয়ার ফলে এলাকার সর্বস্তরের জন সাধারণের মধ্যে সচেতনা তৈরি হয়। বিলবোর্ডে হরিরামপুর, শিবালয়, দৌলতপুর, ঘিওর উপজেলার থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও বিমল রায়, গোলাম সারোয়ার সানু সদস্য ও সভাপতি মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবের মোবাইল নাম্বার দেওয়া হয়। এলাকায় বিলবোর্ডে মোবাইল নাম্বার দেওয়ার ফলে যে কেউ পাখি শিকার করতে আসলে স্থানীয় মানুষের নজরে আসে এবং থানায় খবর দেয়। ইতিমধ্যে স্থানীয় মানুষের সংবাদের ভিত্তিতে হরিরামপুর থানার সহযোগিতায় চর এলাকা থেকে একজন পাখি শিকারিকে ভাম্যমান আদালত পাঁচ হাজার (৫০০০) টাকা জরিমান এবং সিংগাইর থেকে পাখি শিকারে আসা ৫ জনকে দশ হাজার টাকা (১০,০০০ প্রতিজনকে ২০০০ টাকা করে) ভাম্যমান আদালত জরিমানা করেন বন্য পাখি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ৩৮ (১) ক ধারায়।
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবিনা ফেরদৌসী বলেন, “পাখি শিকার রোধে সরকারে আইন আছে, আমাদের সকলের মানতে হবে। আমার কাছে কোন ধরনের পাখি শিকারের খবর আসলে, ভাম্যমান আদালত করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। পাখি শিকারী যে কেউ হোক না কেন ছাড় দেওয়া হবে না। কারণ পাখি পরিবেশের ভারসম্য রক্ষা করে, ফসল উৎপাদনে সহায়ক।” তিনি বলেন, “হরিরামপুরের গোপিনাথপুর বিলকে পাখির অভয়আশ্রম ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে।” পাখি শিকার বন্ধে বিভিন্ন সচেতনতা ও প্রচারণা সম্পর্কে বিমল রায় বলেন, “পাখি রক্ষার জন্য এলাকার লোকজনকে সচেতন হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। যেন এলাকায় এসে কোন লোক পাখি শিকার করতে না পারে। পাখি সকলের বন্ধ,ু পাখিকে বাঁচতে দিতে হবে, পাখি মারা চলবে না।” তিনি আরও বলেন, “পাখির নিরাপদ আবাসস্থলের জন্য দেশীয় গাছপালা রোপণ করতে হবে সকলের।”