ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক গুড়পুকুরের মেলার বর্ণাঢ্য উদ্বোধন
সাতক্ষীরা থেকে বাহলুল করিম
সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক গুড়পুকুরের মেলার বর্ণাঢ্য উদ্বোধন করা হয়েছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মেলার উদ্বোধন করেন সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্যানেল মেয়র কাজী ফিরোজ হাসান, মহিলা কাউন্সিলর ফারাহ দিবা খান সাথী, নাইমুল ইসলাম ডাবলু প্রমুখ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতির সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মেরিনা আক্তার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ডিডিএলজি) শাহ সাদী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোৎসা আরা দত্ত।
অনুষ্ঠানে এমপি রবি বলেন, ‘আজ একটি ঐতিহাসিক মেলার উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। বাসায় আসবাবপত্র থাকা সত্বেও এই মেলাকে ঘিরে অনেকে অপেক্ষা করে বসে থাকেন কখন মেলা হবে তারা আসবাবপত্র কিনবে। গুড়পুকুরের মেলা হওয়ার পিছনে একটি ইতিহাস আছে। পার্বণ বন গুড়পুকুরের সাথে একটি অদ্ভুদ মিল আছে। এই গুড়পুকুরের মেলায় কিন্তু মেঘ গর্জন করে প্রচুর বৃষ্টি হতো। এখনো কিন্তু এই মেলার শুরুতে বৃষ্টি হয়ে থাকে। আমি তখন মুরুব্বীদের কাছে জিজ্ঞাসা করতাম যে আসলে গুড়পুকুরের মেলার সময় এতো বৃষ্টি ও মেঘের গর্জন হয় কেন? এখান থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে তখন মুরুব্বীরা বলতেন গুড়পুকুরের মেলার সময় নাকি সাপ বাচ্চা জন্ম নিতো। এই বাচ্চাগুলো মেঘের গর্জনে নাকি মারা যেত তাই এসময় প্রচুর বৃষ্টি হয়। যাতে সাপের বাচ্চাগুলো মারা না যায়। আমি মেলার সাফল্য কামনা করি। আমরা এই মেলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাই। আশা করি মেলার পরিবেশট ঠিক রেখে আমরা পুরাতন ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারবো।’
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘গুড়পুকুরের মেলা একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা। এই মেলার একটি অন্যরকম বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাতক্ষীরার মানুষের প্রাণের মেলা এটি। আগামী এক মাস মেলাটি চলবে। মেলায় প্রচুর পরিমাণে গাছ বিক্রি হয়। ইতোমধ্যে গাছ বিক্রি শুরু হয়েছে। সবাই স্বতস্ফূর্তভাবে মেলায় অংশগ্রহণ করবেন। আমরা আশা করি আগামী এক মাস কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা না করে স্বতস্ফূর্তভাবে মেলায় অংশগ্রহণ করবো। আমরা মেলার পুরাতন ঐতিহ্যটাকে আবার ফিরিয়ে আনবো।’
প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরার চারশ’ বছরের ঐতিহ্য গুড়পুকুরের মেলা নিয়ে নানা রকম জনশ্রুতি আছে। কেউ বলেন, মোগল আমলে একজন রাজকর্মচারী আজকের সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলের মনসাতলায় (বটবৃক্ষতলে) বিশ্রাম নিতে গিয়ে তন্দ্রাছন্ন হয়ে পড়েন। দিনটি ছিল বাংলা সনের ৩১ ভাদ্র। হঠাৎ তিনি জেগে দেখেন, একেবারে কাছেই একটি সাপ ফণা তুলে তাকে ছায়া দিচ্ছে যাতে ঘুমাতে পারেন। সেই থেকে তিনি ওই বটতলায় সাপের দেবী মনসার উদ্দেশ্যে পূজা শুরু করেন এবং অন্যদেরও মনসা পূজা করতে বলেন। এ পূজার প্রসাদ পুকুরে ফেলে দেয়ায় এর পানি মিষ্টি হয়ে যায়। এ কারণে ওই পুকুরের নাম হয়ে যায় গুড়পুকুর। অন্যরা বলেন, পুকুরে বেশি দিন পানি থাকত না। পরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে স্থানীয়রা সেখানে ১০০ ভাড় গুড় ঢেলে দিলে পুকুরে পানি ওঠে, তাই এমন নামকরণ। আবার শোনা যায়, আশপাশের খেজুর গাছের রস থেকে গুড় তৈরির পর তা বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থেই পুকুরটি খনন করা হয়েছিল। আরেকটি মত হচ্ছে, গৌর বর্ণের ব্রাহ্মণরা পুকুরটির মালিক ছিলেন। এ থেকেই গৌরদের পুকুর। কালক্রমে বিবর্তনের ধারায় গুড়পুকুর।
নামের শানে-নজুল যা-ই হোক, পুকুরের নামেই মেলা হয়ে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে হয়ে আসছে মনসা ও বিশ্বকর্মা পূজাও। এলাকার অনেকেই বলেন, ওই দুই পূজা ঘিরেই মূলত গুড়পুকুর মেলা। যা সাতক্ষীরার সবচেয়ে বড় সামাজিক ও লোকজ উৎসব।