ধানবৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে হরিরামপুরের কৃষকদের উদ্যোগ

মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা

কথায় আছে ভাতে মাছে বাঙালি। গ্রামের কৃষিমাঠগুলোতে সে সময় ভরে থাকতো বৈচিত্র্যময় ধানে। নদীতে মাছ ধরে এ বৈচিত্র্যময় ধানের ভাত খেয়েই কৃষকরা নব উদ্যমে কৃষিকাজ করতেন। বৈচিত্র্যময় ধান থেকে তারা মুড়ি, খই, পিঠা, পায়েস তৈরি করতেন; আপ্যায়ন করতেন। ধানকে কেন্দ্র করে নানান সামাজিক অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করতেন। কম খরচে (সার বিষবিহীন) এ সব বৈচিত্র্যময় ধান আবাদ করতেন তারা। ধান কাটার পর মাঠে পড়ে থাকতো খড়, যা একসময়ে সারে পরিণত হতো। কৃষককে তাই সারের জন্য হাহাকার হতে হতো না। অন্যদিকে জমিতে ভিন্ন ধরনের (ডাল, কলই,পাট) ফসল চাষ করায় মাটির উর্বরতা স্থিতিশীল থাকতো। তবে কৃষকের সেই সুদিন আর নেই। আধুনিক কৃষিচর্চা শুরুর পর থেকে একে একে কৃষি চাষবাসে আসে নানান পরিবর্তন। বীজের জন্য, সারের জন্য এমনকি বালাইনাশকের জন্য কৃষককে কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হতো। কোম্পানির বীজে আবাদ করায় এলাকার যেসব ধানবৈচিত্র্য ছিলো সেগুলো আবাদ কম হওয়া এবং বীজ সংরক্ষণ না করায় কালক্রমে এলাকা থেকে হারিয়ে গেছে। এই প্রসঙ্গে মানিকগঞ্জের বরুন্ডি গ্রামের কৃষক বৈদ্য নাথ সরকার (৫০) বলেন, “ধান চাষে আমরা আউশ মৌসুমে হারিয়েছি, আমন মৌসুমে অল্প সংখ্যক ধান আবাদ করেন কৃষকগণ, বোরো মৌসুমে বিআর-২৯ ও ২৮ ধান চাষ হয়। এই অল্প সংখ্যক ধান চাষ করায় কোন বছর পোকা বা রোগের আক্রমন হলে মাঠে একই ধান হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয় কৃষকের।” এছাড়া অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার সাথে মাটির উর্বরাশক্তিও কমে যেতে থাকে। ফলে কৃষিতে কৃষকের লাভ কমতে কমতে একসময় তারা ধান উৎপাদনে লোকসানের শিকার হয়েছেন। উপরোন্তু নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মাঠের ফসল নষ্ট হওয়ায় তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

12হরিরামপুরের কৃষকরা তাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষি চর্চা ফিরিয়ে আনতে এবং জলবায়ু সহনশীল স্থানীয় জাত সন্ধানের জন্য প্রায়োগিক গবেষণা শুরু করে। এছাড়া মাটি, পানি, পরিবেশকে ভালো রাখান এবং ধানবৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্য কৃষক নেতৃত্বে প্রায়োগিক ধান জাত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বরন্ডি মানিকগঞ্জ সদর প্রায়োগিক ধান জাত গবেষণায় আমন ও বোরো মৌসুমে কৃষকগণ নিবির পর্যবেক্ষণ করে। গবেষণাধীন জাতের বৈশিষ্ট্য ও গুনাগুণসহ আলোচনা পর্যালোচনা করে ধানবৈচিত্র্য বিনিময় করে চাষাবাদ করছেন। কৃষক নেতৃত্বে প্রায়োগিক জাত গবেষণা প্লটে কৃষকদের সমন্বয়ে শুধু গোবর সার দিয়ে চাষ করছেন। ইতিমধ্যে কৃষকগণ ধান গবেষণা প্লট থেকে এলাকা উপযোগী জাত নির্বাচন করে চাষাবাদ করে বিভিন্ন এলাকার কৃষকগণ সফল হয়েছেন। মানিকগঞ্জ জেলায় ৩৪০ জন কৃষক-কৃষানীরা কম খরচে বিভিন্ন জাতের (পুইট্যা আইজং, মকবুল, সোহাগ-৪, ডি আর-১, কাইশ্যাবিন্নি, মিনিকেট, সুবাশ, গুলইরি; আমন মৌসুমে আইজং, পুইট্যা আইজং, মকবুল, কাইশ্যাবিন্নি, মধুশাইল, আমশাইল, ডেপু, তালমুগুর, রাজভোগ, চিনিগুড়া, ডেপর, লক্ষ্মি দিঘা ধান চাষাবাদ করে লাভবান হয়েছে। কৃষকদের মধ্যে আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে ধানবৈচিত্র্য সম্প্রসারণ হচ্ছে।

কৃষকরা জানান কৃষক নিয়ন্ত্রিত প্রায়োগিক গবেষণার কারণে তারা এলাকার জন্য এসব ধান পেয়েছেন। এসব ধানগুলোর মধ্যে দুর্যোগ সহনশীল ধানও রয়েছে। এছাড়া এসব এলাকা উপযোগী ধান আবাদ করে সফল হওয়ায় অন্য কৃষকরাও এসব ধান আবাদে আগ্রহী হয়েছেন। কৃষকের মধ্যে বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ আদান-প্রদান হচ্ছে বলে ধীরে ধীরে এলাকায় ধানবৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। এছাড়া স্থানীয় প্রজাতির এসব উপযোগী ধানে আবাদে উৎপাদন খরচ হচ্ছে বলে কৃষকরা কৃষিতে লাভবান হচ্ছেন। অন্যদিকে নিজেরাই এসব গবেষণা কাজ পরিচালনা করে সফল হয়েছে বলে কৃষকদের আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কৃষির জন্য সুখবর।

কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, কৃষক বাঁচতে হলে কম খরচে বেশি উৎপাদনশীল ধান চাষাবাদে সফল হবে। কৃষক পর্যায়ে গবেষণার ফলে “ধানবৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাবে”, কৃষক তার নিজের ইচ্ছায় বীজ সংরক্ষণ ও আবাদ করে সফল হবে।

 

happy wheels 2