জলবায়ু পরিবর্তন কি ও কেন?
ঢাকা থেকে বাহাউদ্দীন বাহার
জলবায়ু পরিবর্তন বলতে ৩০ বছর বা তার বেশি সময়ে জলবায়ুর উপাদান যেমন তাপমাত্রা বা বৃষ্টিপাতের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে বোঝায়। আমরা আবহাওয়া এবং জলবায়ুকে খুব সহজেই মিলিয়ে ফেলি। এক্ষেত্রে জলবায়ু হচ্ছে আমরা কি আশা করি (যেমন: অত্যন্ত ঠান্ডা শীতকাল) এবং আবহাওয়া হচ্ছে আমরা কি দেখি (যেমন: বৃষ্টি, রোদ)। আবহাওয়া হচ্ছে কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানের নির্দিষ্ট সময়ের (সর্বোচ্চ ৭ দিনের) বায়ুমন্ডলের অবস্থা যা সাধারণত ঠান্ডা, গরম, আর্দ্রতা, বাতাসের গতিবেগ, মেঘের অবস্থা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদির অবস্থা বুঝায়। আর জলবায়ু হচ্ছে কোন অঞ্চলের আবহাওয়া বা বায়ুমন্ডলের উপাদানসমূহের দীর্ঘদিনের (কমপক্ষে ৩০ বছরের) গড়। কোন জায়গার গড় জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদী ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন যার ব্যাপ্তি কয়েক যুগ থেকে কয়েক লাখ বছর পর্যন্ত হতে পারে তাকে জলবায়ু পরিবর্তন (ইংরেজি: Climate change) বলা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্ন নিয়ামকের উপর নির্ভরশীল; যেমন-জৈব প্রক্রিয়াসমূহ, পৃথিবী কর্তৃক গৃহীত সৌর বিকিরণের পরিবর্তন, প্লেট টেক্টনিক্স (plate tectonics), আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ইত্যাদি। তবে, বর্তমানকালে, সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন বললে সারা পৃথিবীর ইদানিং সময়ের মানবিক কার্যক্রমের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন বোঝায় যা বৈশ্বিক উষ্ণতা নামেই বেশি পরিচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, বাতাস, ইত্যদি সূচকের পরিবর্তন হয় ও পরবর্তীতে পৃথিবী পৃষ্ঠে তার প্রভাব পড়ে। এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে সাথে পৃথিবীপৃষ্ঠে হিমবাহের আয়তনের হ্রাস-বৃদ্ধি।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ
যে সমস্ত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া, সৌর বিকিরণের মাত্রা, পৃথিবীর অক্ষরেখার দিক-পরিবর্তন কিংবা সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান। এছাড়া বর্তমান সময়ে মনুষ্যজনিত গ্রীন হাউজ গ্যাস ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকেও জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ ধরা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাংলাদেশ
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত দেশগুলোর একটি, বাংলাদেশ। জাতিসংঘের হিসাব মতে, যদি জলবায়ুর উষ্ণতা এই গতিতে বাড়তে থাকে, তাহলে সমুদ্র ও নদীর স্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় ১ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত হবে। আর বাংলাদেশ হারাবে তার মোট স্থল ভাগের প্রায় ১০ শতাংশ। এদেশের চাষ যোগ্য জমি লবণাক্ততা এবং খরার কারণে পতিত হয়ে যাবে। শীতকালে খরা ও বর্ষাকালে ক্রমবর্ধমান বন্যায় এই দেশ বিপর্যস্ত হবে (হচ্ছে)। প্রতিনিয়ত বন্যা ও সাইক্লোনের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জীবনে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার মতো দাঁড়াবে। বিভিন্ন রকমের রোগ-ব্যাধির সংক্রমণ ঘটবে। সুন্দরবনের মতো আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশের জলবায়ু বিপন্নতার মূল কারণগুলো হলো-ভৌগোলিক অবস্থান, নিচু ও সমতল ব-দ্বীপিয় ভূমিরূপ, ঋতু বৈচিত্র্য বেশি এবং বর্ষা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, জনসংখ্যার ব্যাপক ঘনত্ব ও দরিদ্রতা, অধিকাংশ জনগন কৃষক, কৃষিকাজ জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত প্রভৃতি। বাংলাদেশে প্রতিদিন জলবায়ু বিপন্নদের সংখ্যা বাড়ছে। নদী ভাঙন, প্লাবণ ইত্যাদি কারণে মানুষ ঘরবাড়ি, জমি হারিয়ে পরিবেশ উদ্বাস্তু হচ্ছে যারা পরবর্তীতে শহরাঞ্চলে বস্তিতে মানবেতর জীবন যাপন করে।
মানুষ সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভূমিকা
যে দেশগুলো আজ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের হুমকির সম্মুখীন- সেই দেশগুলো খুব স্বল্প পরিমাণই গ্রীন-হাউজ গ্যাস উদগীরণ করে। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবদান নিতান্তই নগন্য। পরিতাপের বিষয় যে, যে দেশসমূহ গ্রীন-হাউজ গ্যাস উদ্গীরণের জন্য দ্বায়ী, তারা প্রকৃতপক্ষে এই বিষযয়ের করণীয় নিয়ে অনেকাংশেই উদাসীন। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব-নেতৃবৃন্দের অনেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, তাদের সাময়িক লাভের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধের ইস্যুটির প্রয়োজনীয়তা অনেক ব্যাপক।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং উন্নয়ন
সমসাময়িক সময়ে উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায় হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনা করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো ভৌগলিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। ফলে ক্ষতিকর প্রভাবের ধরণ ও মাত্রা বিভিন্ন স্থানে এবং জনগোষ্ঠীতে ভিন্ন হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের ধরণ, মাত্রা এবং হার বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের কাংখিত আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। আবার বাংলাদেশের ভিতরে বিভিন্ন প্রতিবেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব একই রকম নয়; কোথাও কম কোথাও বেশি। পাশাপাশি একই প্রতিবেশে জনগোষ্ঠী ভেদে প্রভাব ভিন্ন হয়। আর একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারী, বয়স্ক এবং শিশুরা আরও বেশি হুমকির সম্মুখীন হয়।
উন্নয়ন নীতি এবং বাস্তবায়নের তাই জলবায়ু পরিবর্তন তাই আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরিওতে বিশ্ব ধরিত্রি সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে নতুন উন্নয়ন নীতিমালা। পরবর্তীতে তৈরি হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু তহবিল। তারই ধারাবাহিকতায় বংলাদেশ সরকারও গঠন করেছে Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan 2009 ২০০৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড ২০১০।
ব্লেইম গেম এবং উন্নয়ন রাজনীতি
কার্বন নির্গমন এবং গ্রীন হাউজ গ্যাসসমূহের বৃদ্ধির জলবায়ু পরিবর্তনের মনুষ্য সৃষ্ট কারণ। সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন হয় জীবাশ্মনির্ভর জ্বালানি, কলকারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের কারণে। আর এই কাজগুলো বেশি করে উন্নত দেশগুলো। কিন্তু হুমকির সম্মূখীন দেশগুলোর ভূমিকা স্বল্প হলেও কখনো কখনো তাদেরকেই দায়ী করা হয়। এর কারণ হিসেবে অনুন্নত দেশগুলোর কাঠনির্ভর জ্বালানি এবং পরিবেশ দূষণকেই চিহ্নিত করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন বেশি দায়ী দেশগুলোর হুমকি কম থাকায় এর মোকাবেলার দায়িত্ব অনেক সময় স্বীকার করতে নারাজ। আবার স্বীকার করলেও সেটি বিভিন্ন চুক্তি এবং নীতিতেই সীমাবদ্ধ। আবার হুমকির সম্মুখীন দেশগুলো যে পরিমাণ অর্থ এবং সহায়তা পাচ্ছে তার যথাযথ ব্যবহার এবং সেটি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাজে লাগছে কিনা সেটিও গবেষণার দাবি রাখে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জননেতৃত্বের চর্চাসমূহ
জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির সম্মুখীন জনগোষ্ঠীসমূহ প্রতিনিয়ত তাদের নিজস্ব লোকায়ত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে নানা চর্চার মাধ্যমে। উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠী অর্থকরী চিংড়ির পরিবর্তে বেছে নিচ্ছে ধান, করছে সমন্বিত চর বনায়ন, বরেন্দ্র অঞ্চলে শুরু করছে বৈচিত্র্যময় রবি শস্য চাষ, নিচু জমিতে চাষ করছে জলী আমন, প্রভৃতি উদ্যোগ নিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিবেশে নানা জনগোষ্ঠী। তারা বসে নেই বৈশ্বিক বা জাতীয় নীতি ও তহবিলের জন্য।