জলাভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য

জলাভূমি ঘিরে রাষ্ট্রীয় সকল সংজ্ঞায় একটি মিল রয়েছে। দেখা যাচ্ছে জলাভূমির সকল ঐতিহাসিকতাকে বাতিল করে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় নীতি ও নথি জলাভূমিকে করপোরেট বাণিজ্যের চশমায় দেখে চলেছে। যেন জলাভূমি মানে একদলা জমানো পানি, বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ, পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থল আর পর্যটন-বাণিজ্য। জলাভূমি নিয়ে কোনো রাষ্ট্রীয় সংজ্ঞাতে জলাভূমির প্রাণস্পন্দন ও জীবনের ছন্দ পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকতা ও জীবনপ্রবাহের কোনো ধারা এখানে নেই। ভিন্ন ভিন্ন জলাভূমির সাথে প্রাণ ও প্রকৃতির যে জটিল সম্পর্ক এবং বিকাশ তা রাষ্ট্রের জলাভূমি বিষয়ক চিন্তা ও দর্শনে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর দেশজুড়ে জলাভূমিসমূহের করুণ যন্ত্রণা ও সংকটের নাভিবিন্দুটি এখানেই। জলাভূমিকে কীভাবে, কার চোখে দেখা হচ্ছে। ধারণ করা হচ্ছে।

দেশজুড়ে জলাভূমির অবস্থান, চরিত্র, স্বভাব ও জীবনপ্রণালী ভিন্ন ভিন্ন। পাহাড়ি অঞ্চলের ঝিরি, ঝর্ণা, হ্রদ, কুন্ড থেকে শুরু করে বিল, বাওড়, খাল, খাঁড়ি, বাইদ, হাওর। পুকুর, দীঘি থেকে শুরু করে নদীপ্রণালী কি সমুদ্র। দেশের নানাপ্রান্তের ভিন্ন ভিন্ন জলাভূমি জীবনে অভ্যস্ত জনজীবনের কাছে জলাভূমির ব্যঞ্জনা ও সম্পর্ক গুলো ভিন্ন ভিন্ন। তারপরও দেশজুড়ে জলাভূমির একটি পাবলিক সংজ্ঞা আছে। জলাভূমি মানে ‘জলাভূমি আশ্রিত জীবনপ্রবাহ’। কেন আজ দেশজুড়ে জলাভূমি সমূহের দু:সহ করুণ অবস্থা? প্রধান কারণ হলো আমরা জলাভূমির এই পাবলিক সংজ্ঞা মানছি না। দেশের জলাভূমিগুলো সম্পর্কে একবারেই না জেনে, না বোঝে, সেই জীবনের সাথে কোনোভাবেই একাত্ম না হয়ে গায়ের জোরে ‘জলাভুমি উন্নয়ন কি সংরক্ষণের’ পাতানো দরদ দেখাই। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৯ বর্ষা পেরুলেও এখনও আমরা জলাভূমির প্রতি এক বিঘৎ দরদ ও দায়িত্ব দেখাতে পারিনি। আমরা জলাভূমিকে বরাবর এখনও ‘পতিত’ নিচুঅঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করি। গায়ের জোরে দখল, নিয়ন্ত্রণ ও দূষণ করি। লন্ডভন্ড করে দিই। আমরা চলতি আলাপে দেশের নানাপ্রান্তের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জলাভূমির করুণ আহাজারিকে টেনে আনবো। নয়াউদাবাদী চিন্তা আর পুরুষালি উন্নয়নের আঘাত কীভাবে বারবার কীভাবে দেশের জলাভূমিসভ্যতা ছিন্নভিন্ন করে চলেছে তা আমাদের একত্র করেই জানা-বোঝা জরুরি। এমনি এমনি কোথাও শহর গজিয়ে ওঠেনি, এমনি এমনি বিশাল কোনো দালান বা দেশের বৃহৎ শপিং মল বা রিয়েল এস্টেট বাণিজ্য গড়ে ওঠেনি। এর জন্য নাতিপুতিসহ মা-দিদিমা জলাভূমিদের জীবন দিতে হয়েছে। বলা উচিত জলাভূমি হত্যা করেই আমাদের লোভাতুর নগর ও ধাঁধানো বাণিজ্য গড়ে ওঠেছে। নির্দয়ভাবে টিকে থাকছে। মোটাতাজা ও ভুঁড়িঅলা হচ্ছে। জলাভূমির লাশের ওপর দাঁড়িয়ে হয়তো কোনো এক বিশেষ কোনো দিবসে আমরা মায়াকান্নার মাতম তুলছি। রক্ষা কর করতে হবে, আমাদের জলাভূমি জীবন বাঁচায়, ঝুঁকি কমায়। এ দিয়ে হবে না। এর জন্য মুক্তিআন্দোলনই একমাত্র পথ। কারণ দীর্ঘ বন্দীদশা আর অন্যায় আঘাত চুরমার করতে পাবলিক জাগরণই পরীক্ষিত প্রস্তাব। হাওরের ভাসান পানিতে পাবলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুনামগঞ্জে গড়ে ওঠা ‘ভাসান পানির আন্দোলন’, দক্ষিণাঞ্চলের ‘ভবদহ বা বিলডাকাতিয়া আন্দোলন’ তাই সাক্ষ্য দেয়। মেয়াদোত্তীর্ণ তথ্য, গড়মিল বিশ্লেষণ আর দখলিপনার মর্জি দিয়ে জলাভূমি বাঁচবে না। এর জন্য একেবারেই জলাভূমি জীবনের মানুষ দরকার। যাদের পা ফাটা এবং শরীরে আঁশটে ঝাঁঝ কিন্তু তথ্যে তীব্র, যুক্তিতে সপ্রতিভ এবং সংরক্ষণে মমতাময়।

চলনবিল

বলা হয়ে থাকে দেশের বৃহত্তম বিল চলন বিল। চলনবিলের পাড়ে নাটোরের জোয়াড়ি গ্রামে ১৯০১ সনে জন্মান প্রমথনাথ বিশী। সাহিত্যিক, শিক্ষক ও রাজনীতিক। ১৯৫১ সনে প্রকাশিত ‘চলনবিল’ বইতে প্রমথনাশ লিখেছেন, …অনুমান করলে অন্যায় হবে না যে, চারশত বৎসর পূর্বে এ বিলটি রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিরাজ করতো। ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার সঙ্গমস্থলের পশ্চিমোত্তর অংশে চলনবিল বিরাজিত। অবস্থান, আকৃতি, প্রকৃতি দেখে চলনবিলকে উত্তর বাংলার নদ-নদী-¯œায়ুজালের নাভিকেন্দ্র বললে অত্যুক্তি হবে না।’ দেশের সবচে’ বড় বিল হিসেবে পরিচিত ‘চলনবিলকে’ নিদারুণভাবে এলোপাথারি উন্নয়নের কোপে ফালি ফালি করা হচ্ছে। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকেও বিলটির আয়তন ছিল প্রায় এক হাজার বর্গ কি.মি.। চলতি সময়ে তা মাত্র ৩৬৮ বর্গ কি.মি. এ দাঁড়িয়েছে। বর্ষাতে জলের বিস্তার থাকলেও হেমন্তে এর আয়তন দাঁড়ায় ২৫.৯ বর্গ কি.মি.। নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলা, পাবনার ভাঙ্গুরা ও চাটমোহর উপজেলা, নওগাঁর আত্রাই উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া উপজেলায় বিস্তৃত দেশের এই বৃহত্তম বিলের বুকের কলিজা থ্যাৎলে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সড়কপথ। শুধুমাত্র চলনবিল নয়, দেশের সকল বিল জলাভূমিই আজ অধিপতি উন্নয়নের বাহাদুরিতে রক্তাক্ত।

আন্ধাসুরা বিল

নওগাঁ বরেন্দ্রভূমির এক ঐতিহাসিক অঞ্চল। রুক্ষ বরেন্দ্র হলেও নওগাঁর মান্দা জলাভূমিময়। মান্দার ভারশোঁ ইউনিয়নে বিস্তৃত এক প্রাচীন বিল আন্ধাসুরা। প্রাচীন এক শূয়রকালীর থান থেকেই বিলটি নাম পায় আন্ধাসুরা। এই বিলের আরো বোন আছে। যেমন রাজশাহীর তানোরের বিলকুমারী। শিব নদীর সাথে বিলকুমারীর প্রণয়, বিয়ে হয়নি। আন্ধাসুরাসহ সব বোনেরাই এখনও অবিবাহিত। মালের মাছ, বাইটকা, নয়না ও শেরণ পুঁটির জন্য আন্দাসুরা বিখ্যাত ছিল। আর ছিল নিকাড় মানে মাখনা। এসব আর নেই। প্রভাবমালী বাঙালি মুসলিম পুরুষরা এই বিলকে জবরদখল করে রেখেছে। বিলবাসীদের বিলে নামতে দিচ্ছে না। এ নিয়ে মামলা, হামলা হয়েছে।

গুমাই বিল

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিল। বলা হয়ে থাকে, এক গুমাই বিলে উৎপাদিত ধান থেকে দেশের আড়াই দিনের খাদ্য জোগান হয়। পাশেই কর্ণফুলী কাগজকল। কাগজকলের দু:সহ দূষণে গুমাই বিল আক্রান্ত। গুমাই বিলের পানি উৎস যে ছড়া ও খাল গুলো তা নানাভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অবিরাম ইটভাটা গড়ে ওঠছে এবং পুরো বিল দখল হয়ে যাচ্ছে।

আড়িয়ল বিল

মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা জেলার তিনটি উপজেলায় বিস্তৃত দেশের মধ্যঅঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ বিল আড়িয়ল। ২৬ মাইল দৈর্ঘ্য এবং ১০ মাইল প্রস্থের এই প্রবীণ জলাভূমির মোট আয়তন এক লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর। আশেপাশের ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ৭০টি গ্রামের জীবনধারা নিয়েই ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে আড়িয়ল-সভ্যতা। শতবছর আগে ইতিহাসকার যতীন্দ্রমোহন রায় এই বিলের প্রশস্তি টেনে লিখেছেন, চলবিল ও আইরল (আড়িয়ল) বিলেই অতি প্রাচীনকালে ব্র‏হ্মপুত্রের সঙ্গম ঘটেছিল। রাষ্ট্র আড়িয়ল-সভ্যতাকে অস্বীকার করে বিমানবন্দর করতে চেয়েছিল। প্রবল জনরোষের মুখে তা বাতিল হয়।

বিল ডাকাতিয়া

খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলায় বিস্তৃত বিলডাকাতিয়া এমনি আরেক দু:সহ উন্নয়ন-ক্ষত। উপকূলীয় বাঁধ, বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘের বিলডাকাতিয়াকে তীব্র লবনজলে বন্দী করে রেখেছিল দীর্ঘসময়।

বেল্লা বিল

শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বংশাই নদীর প্রান্ত ছুঁয়ে গাজীপুর, নরসিংদী জেলার ভূমিরূপের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য তার বিল এলাকাসমূহ। এরকমই একটি বিল এলাকা ভাওয়ালগড়ের গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়ন। এই এলাকার সবচে’ প্রশস্ত বিল বেল্লা বিল, যা ভরা বর্ষায় প্রান্তরব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। তথাকথিত উন্নয়নের চাপে এইসব ঠিকানা ও স্মৃতিচিহ্ন আজ ধুয়েমুছে গেছে। আশির দশকে এই এলাকার বিলপ্রতিবেশ ও জনজীবনের সম্পর্ককে বিবেচনা না করে তৈরী করা হয় ভেড়িবাঁধ।

চান্দার বিল

গোপালগঞ্জ ও মাদারিপুরে বিস্তৃত চান্দার বিল কৈ মাছের এক বিশাল প্রাকৃতিক বিচরণ এলাকা। দীঘা, কুমড়োগড়, নেতপাশা, খইয়ামটর, গৌরকাজল মতো গভীর পানির ধান ও জলে ভাসা ধানের জন্ম দিয়েছে এই বিল। গাউতার মতো ভাসমান চাষপদ্ধতির উদ্ভবও এখানে। এখানেই চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা ডুবে যায়। ঐতিহাসিক এই বিল আজ কর্পোরেট রাসায়নিক কৃষির অত্যাচার আর পানিপ্রবাহহীনতায় বিপন্ন।

হাওরাঞ্চল

বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের এক ভাগ জুড়েই হাওর জলাভূমি। সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি জেলায় প্রায় ৪৮টি বড় হাওর নিয়ে মোট ৪২৭ টি হাওরভূমি আমাদের দেশের মোট জাতীয় উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্ষাকালে এই জলাভূমি প্রায় ২৪,০০০ বর্গ কি.মি. এলাকা নিয়ে বি¯তৃত হয়ে পড়ে। দিন দিন হাওর জলাশয়ে স্থানীয় মানুষের প্রবেশাধিকার সংকুচিত হচ্ছে, প্রায় সকল হাওর জলাভূমি দখল ও ব্যাক্তিমালিকানাধীন হয়ে পড়ছে। পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল হিসেবে খ্যাত সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা। কিন্তু উজানের মেঘালয় পাহাড়ের বাণিজ্যিক কয়লা ও পাথর খনির বর্জ্যরে আঘাত সহ্য করেই কোনোমতে টিকে আছে এই গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। অন্যদিকে রামসার এলাকা সংরক্ষণের নামে হাওরনির্ভর জেলেদের কাছ থেকে এই জলাভূমিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

১৯৯৭ সনের আগেও বিভিন্ন উদ্যাগ নেয়া হলেও এ সন থেকেই প্রথম প্রতি বছরের ২ ফেব্র“য়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়। প্রতি বছরই পৃথিবীর জলাভূমি সমূহের গুরুত্ব এবং এর সাথে জনগণের সম্পর্ক এবং উন্নয়নধারাকে বিবেচনা করে প্রতি বছরের জন্যই এক একটি প্রতিপাদ্য তৈরী করা হয়। ২০০৬ সনে জলাভূমি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘জলাভূমিসমূহ এবং পানিনির্ভর জীবন ও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রা’, ২০০৭ সনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আগামীর জন্য মাছ?’, ২০০৮ সনে ‘স্বাস্থ্যকর জলাভূমি, স্বাস্থ্যকর জনগণ’, ২০০৯ সনে ‘নদী ও নদী তীর ব্যবস্থাপনা’, ২০১০ সনে ‘প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ু পবির্তন’, ২০১১ সনে ‘জলাভূমি ও জংগল’, ২০১২ সনে ‘জলাভূমি ও পর্যটন’, ২০১৩ সনে ‘জলাভূমি ও পানিব্যবস্থাপনা’, ২০১৪ এবং ২০১৫ সনের প্রতিপাদ্য ‘জলাভূমি সমূহই আমাদের ভবিষ্যত’, ২০১৬ ‘জলাভূমি আমাদের ভবিষ্যত ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন’, ২০১৭ ‘জলাভূমি দূর্যোগ কমায় বা জলাভূমি দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস করে, ২০১৮ ’ স্থায়িত্বশীল ভবিষ্যত নগরের জন্য জলাভূমি’, ২০১৯ ‘জলাভূমি ও জলবায়ু পরিবর্তন’। ২০২০ সনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘জলাভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য’। জলাভূমিসমূহ আমাদের এই বৃহৎ বদ্বীপের প্রাণবৈচিত্র্যের আঁতুরঘর। কিন্তু আমরা জলাভূমি প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষায় এখনো দায়িত্বশীল নই।

…………………………………………………………………………………………

পাভেল পার্থ

গবেষক ও লেখক। [email protected]

happy wheels 2

Comments