খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের চাষ বৃদ্ধি করুন
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম
ভৌগোলিক কারণেই প্রাচীনকাল থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলটি খরা প্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। একসময় এই খরা মোকাবেলায় স্থানীয় মানুষের ছিলো নানা কৌশল আর বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের চাষ। একসময় এই অঞ্চলে প্রকৃতিক জলাধার তথা নদী-নালা, খাল-খাড়িসহ বিভিন্ন উৎস থেকে মানুষ পানির চাহিদা মেটাতো। কিন্তু বিভিন্ন কারণেই বর্তমান প্রাকৃতিক জলাধারগুলো আজ ধ্বংসের দিকে। নদীতে পানি থাকে না। খাল খাড়িগুলোতে গোটা মৌসুমে পানি থাকে না। দিনে দিনে পানি সমস্যা বেড়েই চলেছে। উন্নয়ন রূপান্তরে বরেন্দ্র অঞ্চলের উন্নয়নে অন্যতম একটি মাধ্যম এই পানি। আর এই পানি সংকট সমাধানে ভূগর্ভস্থ থেকে পানি তোলা শুরু হয়। অধিক পানি কেন্দ্রিক শস্য ফসলে চাষ তথা ধান চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে কৃষকরা। এর ফলে রবিশস্য ফসলের জন্য উপযোগী বরেন্দ্র অঞ্চলে কম পানি নির্ভর শস্য ফসলের চাষবাদের স্থান দখল করে নেয় অধিক পানি ব্যবহার ফসল ধান।
মাটির গুণাগুনের কারণসহ নানা কারণেই বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিনে দিনে কমতে শুরু করেছে। এর ফলে একসময় এই অঞ্চলে পানি কেন্দ্রিক দুর্যোগ শুরু হবার সম্ভাবনা দেখা দিবে। একদিকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের আঞ্চলিক অভিঘাত, অন্যদিকে মনুষ্য সৃষ্ট উন্নয়ন কর্মকান্ডে দুর্যোগ বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি নিরাপত্তাসহ জীবন-বৈচিত্র্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক স্থানেই তার ভয়াবহতা শুরু হয়ে গেছে। তেমনি তানোর উপজেলার বাঁধাইর ইউনিয়নসহ আরো অনেক এলাকায় পানির অভাবে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম সংকট হচ্ছে পানির অভাবে শস্য ফসলের চাষ ব্যাহত, মানুষের কর্মসংস্থান অভাব, এলাকার মানুষ স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে স্থান্তারিত হওয়ার দিকগুলো দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
গত ৭ মে ২০১৬ সালের দৈনিক প্রথম আলোর ‘পানিসংকটে জমি অনাবাদি, বাড়ি ছেড়েছে ১০০ পরিবার’ শিরোনামে বলা হয়, পানির অভাবে ফসল হচ্ছে না বরেন্দ্র এলাকার জমিতে। দিন কাটছে অভাব-অনটন আর দুশ্চিন্তায়, সপরিবারে এলাকা ছেড়েছে মানুষ। প্রথম আলোর অনুসন্ধানী তথ্য মতে, রাজশাহীর তানোর উপজেলার ৪৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাঁধাইর ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ২১ হাজারের মতো। ইউনিয়নের ২৫ শতাংশ জমি বরেন্দ্র সেচ প্রকল্পের আওতায় আছে। বাকী জমি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। অধিকাংশ জমি সেচ প্রকল্পের বাইরে হওয়ায় এখানে পানি সংকট তুলনামূলক বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলে বষ্টির পরিমাণ কমে গেছে। অন্যদিকে মানুষের কার্যক্রমের কারণে প্রাকৃতিক জলাধারগুলোও আগের মতো পানির যোগান দিতে পারেনা।
সার্বিক দিক বিবেচনায় বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি নিরাপত্তা এক সংকটের মধ্যে পড়েছে। তাই আগামীতে এই অঞ্চলের স্থায়িত্ব উন্নয়নে পানি নিরাপত্তা নিয়ে এই এলাকা উপযোগী সমন্বিত কর্মউদ্যোগুলো নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। পাতাল থেকে পানি উত্তোলন করে সাময়িক সমস্যা সমাধান করলেও দিনে দিনে ভয়ংকরভাবে পাতালের পানি অনেক নীচে নেমে যাচ্ছে, যা জীববৈচিত্র্য এবং এই অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের জন্য অনেক বেশি ঝুঁকি বয়ে আনবে।
খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করনে সম্প্রতি রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দ ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে পানি ব্যবস্থাপনা ও বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের চাষ বিষয়ক মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। বারসিক, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তানোর জোন, বরেন্দ্র অঞ্চল জনসংগঠন সমন্বয় কমিটি ও তালন্দ ইউনিয়ন পরিষদের যৌথ আয়োজনে উক্ত মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময়ে তালন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্ব এতে আলোচক ও সন্মানিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন তানোর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফর রশিদ হায়দার ময়না, তানোর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুশান্ত কুমার মাহাতো, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম, জাতীয় পরিবেশ পদক প্রাপ্ত কৃষক ইউসুফ আলী মোল্লা, জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত আদর্শ কৃষক নূর মোহাম্মদ।
এতে তানোরসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪৫ জন গভীর নলকূপ ব্যবস্থাপনার অপারেটর এবং প্রায় ৩০ জন কৃষক প্রতিনিধিসহ সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭০ নারী পুরুষ অংশগ্রহণ করেন।
বক্তারা বলেন, ‘পানি সংকটাপন্ন বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি নিরাপত্তায় প্রয়োজন পানি সাশ্রয়ী শস্য ফসলের চাষ এবং পানির অপচয়রোধ। পানির অপচয়রোধে ডিপ অপারেটরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে। ভুগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। দেশীয় প্রজাতির কম পানি নির্ভর রবিশস্য ফসলের চাষাবাদ বাড়াতে হবে।’
উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের সময় হয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলে বৈচিত্র্যময় কম পানিনির্ভর শস্য ফসলের চাষ করার।’ তিনি এলাকা উপযোগী খরা সহনশীল জাতগুলো চাষের পরামর্শ দেন। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তপক্ষের সহকারি প্রোকৌশলী বলেন, ‘সরকারিভাবে বার বার বলা হচ্ছে রবি শস্য চাষের, কিন্তু আমরা তারপরেও কম লাভের আর বেশি খরচের শুধু ধান উৎপাদন করি।’ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই সরকারি নিয়ম কানুন মানতে হবে।’ তিনি সবাইকে পানি নিরাপত্তা বিধানে পানির অপচয় যাতে কম হয় সেই ধরনের ফসলের চাষ করতে বলেন।
কৃষক প্রতিনিধি পরিবশে পদ প্রাপ্ত ইউসুফ আলী মোল্লা বলেন, ‘ডিপের আশে পাশে রবিশস্য চাষ করতে অনেক সময় ধানের জমিতে পানি দিতে রবি শস্য ফসল নষ্ট করা হয়, আবার অনেক সময় ডিপের অপারেটররা রবি শস্য চাষীদের পানি দিতেও হয়রানি করেন। এর ফলে কম পানি নির্ভর রবিশস্য চাষীরা দিনে দিনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।’
মতবিনিময়ে সকলের মতামতে নিয়ে সভাপতি বলেন আগামীতে ডিপের আন্ডারে যেসকল চাষী কম পানি নির্ভর রবিশস্য ফসলের বা অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ করবে তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।