করোনায় ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের পাশে পরিবার ও সমাজ
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
ভূমিকা
বহুত্ববাদি সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ বারসিক কাজ করে আসছে। এই কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, আমাদের সমাজে ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের অবস্থা অনেকটাই শোচনীয়। পরিবার বা সমাজে তাঁদের মূল্যায়ন হচ্ছে না। তাছাড়া কেন মানুষ প্রতিবন্ধি হয়ে জন্মগ্রহণ করে এ বিষয়েও কারো ধারণা নেই। আমাদের সমাজ অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে গেলেও গ্রামীণ সমাজে বিভিন্ন কুসংস্কার এখনো প্রচলিত। প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেওয়াকে কোনো কোনো জায়গায় এখনো অভিশাপ বা নারীদের দোষারোপ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এর পেছনের কারণ কেউ জানেনা। সমাজের বৈচিত্র্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে যেমন একজন সুস্থ মানুষের প্রয়োজন আছে, তেমন ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিরও প্রয়োজন আছে। কারণ তাঁরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাঁরাও সুস্থ মানুষের মতই সমাজে ভিন্নভাবে অবদান রাখতে সক্ষম।
ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের পাশে বারসিক
আমাদের দেশের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের অজ্ঞতা, ভয় ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে তাঁদের অংশগ্রহণ ও অধিকার খুবই নগণ্য। সামাজিক নানা প্রকারের নেতিবাচক কুসংস্কার তাঁদের সবার থেকে আলাদা করে রাখতে চায়। তাঁদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে পরিবার বা সমাজের অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলা বা চলাফেরা করতে গিয়ে নানা ধরণের অসুবিধা মোকাবেলা করতে হয়। যে কারণে প্রতিবন্ধিদের সাথে নৈতিবাচক আচরণ করতেও কেউ দ্বিধাবোধ করেনা।
পুরুষদের বেলায় এই সমস্যগুলো এতোটা গুরুতর না হলেও নারীদের বেলায় খুব বেশি দেখা যায়। প্রতিবন্ধী কিশোরী বা নারীদের জন্য পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন ধরণের সমস্যায় পড়তে হয়। তাছাড়া নারীদের সাথে অনেকেই অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকে। শারীরিক বা মানসিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে পরিবার এবং সমাজের ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিরা আরো কঠিন সদস্যার মধ্যে পড়ছে। এ সমস্ত কারণেই প্রতিবন্ধীতা বিষয়ে সমাজের মানুষকে সচেতন করাটা প্রথমে জরুরি বলে মনে করে বারসিক।
কিভাবে শুরু এবং কি কাজ
নিয়মিত বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে বারসিক তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এবং তাঁদের সমস্যাসমূহ জানার চেষ্টা করে। কিন্তু এ বিষয়ে জনগোষ্ঠীর সাথে তথ্য বিনিময় করতে গেলে যে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন সেটি বারসিক’র নেই। কারণ এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়। তাই এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানার জন্য বারসিক প্রতিষ্ঠানগতভাবে নিজস্ব কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করে। এখানে প্রশিক্ষক হিসের তাঁরাই দায়িত্ব পালক করেন, যারা দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে আসছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, থেরাপিস্ট, সমাজকর্মী ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সেবা প্রদান করে আসছে সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
এ সমস্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতা কি ও এর কারণ, এর প্রকারভেদ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার, প্রতিবন্ধি বিষয়ক বিভিন্ন ধরণের আইন, প্রতিবন্ধি সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র থেকে প্রদত্ত সেবাসমূহ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হয়। প্রতিবন্ধীতার বিভিন্ন ধরণ জানার পর দেখা যায়, শারীরিক প্রতিবন্ধীতা ছাড়া অন্যান্য ধরণের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করতে গেলে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ ও উপকরণের প্রয়োজন হয়।
প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর বারসিক কর্মএলাকায় প্রথমে পরিবার পর্যায়ে প্রতিবন্ধীতার বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতামূলক আলোচনা শুরু করে। পরিবার ও সমাজের কুসংস্কার দূর করতে এ ধরণের আলোচনা যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সামাজিকভাবে প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন, প্রতিবন্ধী বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে আলোচনা ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়া যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন ধরণের সেবা ও সুযোগ সুবিধা প্রদান করে আসছে, সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে জনগোষ্ঠী পর্যায়ে সম্পর্ক তৈরি করে দেওয়ার কাজটিও করে বারসিক। ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে একক আলোচনা, গ্রাম পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তালিকা সংগ্রহ করে ইউনিয়ন পরিষদে জমা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগঠন তৈরী ইত্যাদি কাজ চলে সমান পর্যায়ে।
পরিবার পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের সহযোগিতায় প্রতিবন্ধীতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করে। পাশাপাশি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীতা যাদের আছে তাদের নিয়ে তিন দিনব্যাপী স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালা আয়োজন করা হয়। নেত্রকোণা জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কার্যালয়ের সহযোগিতায় এই কর্মশালাটি সম্পন্ন করা হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি
করোনাকালীন সময়ে সামাজিক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিবন্ধি ব্যক্তিরা বেশি ঝুঁকিতে পড়ে যায়। তাঁদের এই ঝুঁকি মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে পরিবার ও সমাজ। পরিবারের সদস্যরা তাঁদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের পাশাপাশি তাঁদের সময় দিচ্ছে। বিশেষ করে কিশোরী বা নারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দিকে আলাদা খেয়াল রাখছেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ঘরে রাখতে ও আনন্দ দিতে পরিবারের সদস্যরা বিনোদনমূলক খেলার ব্যবস্থা করেছেন। তাছাড়া করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় করণীয়, তাঁদের চিকিৎসাসহ নানা বিষয়ে যত্ন সহকারে খোঁজ রাখছেন।
এছাড়া কর্মএলাকার বিভিন্ন জনসংগঠনও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। সদস্যরা ইউনিয়ন পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের সময় মতো ভাতা প্রদান নিশ্চিত করেছেন। তাছাড়া তিন মাসের অগ্রিম ভাতা পেতে সহযোগিতা করেছেন।
সরকারি পর্যায়ে করোনা মুহূর্তে বিভিন্ন প্রণোদনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভূক্ত করেছেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এ সমস্ত প্রণোদনার আওতায় নগদ অর্থ, ঈদ ইপহার সামগ্রী ইত্যাদি পেয়েছেন।
অবশেষে
করোনায় আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন আজ ব্যাহত। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এমনিতেই স¦াভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারেনা। তাই তাঁদের নিয়ে পরিবারের চিন্তারও কমতি নেই। যারা শারীরিকভাবে অক্ষম বা মানসিক বিপর্যস্ত ব্যক্তি আছেন তাঁদের জন্য এই সময়ে পরিবারের ব্যক্তিদের অনেক সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে। যে সমস্ত শ্রবণ প্রতিবন্ধী বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন তাঁদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে গেলে স্পর্শ করতে হয়। তাঁরা এগুলো বুঝতে পারেনা। তাই পরিবারের সদস্যদের এ বিষয়ে আরো সচেতন থাকতে হয়েছে।
চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়েও নানা ধরণের ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তাছাড়া সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে গিয়ে তাঁদের বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। অনেকসময় মানসিক প্রতিবন্ধি ব্যক্তিরা পরিবারের সদস্যদের সাথে রাগারাগি বা মারামারি পর্যন্ত করেছে। তবুও পরিবারের সদস্যরা তাঁদের সাময়িক অত্যাচার সহ্য করেছেন।বর্তমান সময়ে সব ধরণের মানুষ এক প্রকার অজানা আশংকায় দিনযাপন করছেন। যারা এই আশংকার বিষয়ে অন্যদের বলতে বা জানাতে পারে তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পায়। আর যারা এ বিষয়ে অজ্ঞ তারা না পারে বলতে বা কিছু বুঝতে। আমাদের সমাজে সুস্থ ব্যক্তির পাশাপাশি ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিরাও রয়েছে। তাঁদের সমস্যা মোকাবেলা করতে পারলেই সুস্থভাবে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করা যাবে।