কোভিড-১৯ মহামারী থেকে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের সুরক্ষায় গ্রামীন নারী
নেত্রকোনা থেকে পাবর্তী রানী সিংহ
পুরো পৃথিবী এখন অনাকাক্ষিত সংকটে। মানুষের জীবনযাপনের অস্বাভাবিকতা, অর্থনৈতিক চাকার নিম্নগামীতায় অসহায় হয়ে পড়েছে অনুন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নত দেশগুলো। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ শুধুমাত্র টিকে আছে কৃষি ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে। মানুষকে বেচেঁ থাকার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। ঐতিহাসিকভাবে এই কৃষির সূচনা হয়েছিল নারীর হাত ধরেই। এখনো টিকে আছে নারীর সাথে কৃষির সম্পৃক্ততা যা অনেক মহল স্বীকার করতে চান না। প্রতিনিয়ত কৃষি সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে আসছে আমাদের গ্রামীণ নারীরা। তাদের নিত্যদিনের কাজ, নিজস্ব জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, লোকায়ত চর্চা কৃষিকে করেছে সমৃদ্ধ। কৃষির বৈচিত্রময়তা টিকে আছে আমাদের গ্রামীণ নারীর চর্চার মধ্য দিয়ে। ভিন্ন ভিন্ন বা বৈচিত্র্যময় শাকসবজি চাষাবাদ, নিজেদের স্থানীয় উপকরণ দিয়ে বীজ সংরক্ষণ, আবহাওয়াকে চিন্তা করে বীজ রোপণ, বপন, সংরক্ষণ, সময় জ্ঞান বিবেচনা করে সবজি বা ফসল উত্তোলন ইত্যাদি কাজ করেন এই নারীরা। মোট কথা, উৎপাদন থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা, উত্তোলন, সংরক্ষণ পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে এদেশের গ্রামীণ নারীরা তাদের জ্ঞান, দক্ষতা অভিজ্ঞতা ও শ্রম সমৃদ্ধ করে চলেছে দেশের কৃষির উৎপাদন ও খাদ্য সংস্কৃতিকে।
ঐতিহাসিকভাবে আমাদের গ্রামীণ নারীরা কৃষি ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন।মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে ছয়টি মৌলিক চাহিদা রয়েছে তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূণ উপাদান হল খাদ্য। যা পুরণে সবচা্ইতে বড় অবদান রেখে চলেছেন এদেশের গ্রামীণ নারীরা।এই চর্চার ভেতর দিয়েই গ্রামীণ নারীরা গড়ে তুলেছেন এক সমৃদ্ধ খাদ্র সংস্কৃতি।অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, চলমান কোভিড-১৯ এখনও যে গ্রামের মানুষের সম্পৃক্ততা কম তার অন্যতম একটি কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে গ্রামীণ মানুষের নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি ও জীবনধারণ ব্যবস্থাজনিত রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা, যা গ্রামীণ নারীর দীর্ঘদিনের চর্চার ভেতর দিয়েই বিকশিত হয়েছে। শুধু মাঠ চাষকৃত ফসল তথা, ধান, গম, আলু, দিয়েই গ্রামীণ মানুষের প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পুর্ণ হয়না। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক উৎস্ থেকেও তা আহরণ করতে হয়, যা দেখা যায় গ্রামীণ নারীর চিন্তা ও চর্চায়।খাদ্যের উৎপাদন যেমন বীজ রোপণ, বপন, পরিচর্যা, রোগ দমন উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত করন প্রতিটি কাজেই থাকে নারীর সম্পর্ক। এগুলো করে থাকে নিজের আশপাশে থাকা গাছ-গাছালি ও নিজস্ব উপকরণ দিয়ে।
বারসিক তাদের এই কাজকে, তাদের জ্ঞানকে শুরু থেকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে এবং সম্মান করে।বারসিক বিশ্বাস করে, যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংকট মোকাবেলার অন্যতম উপায় হচ্ছে স্থানীয় প্রকৃতিক সম্পদের নিজস্ব জ্ঞাননির্ভর ব্যবস্থাপনা। এই কাজটি অত্যন্ত সফলভাবে করে আসছেন প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাথমিক ব্যবকারী হিসেবে আমাদের দেশের গ্রামীণ নারীরা। চলমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় নেত্রকোনা এলকার গ্রামীণ নারীরা তারই প্রমাণ রেখে চলেছেন নিরন্তর। সেটি কখনো ব্যক্তিগতভাবে, কখনো পারিবারিক পর্যায়ে চর্চার ভেতর দিয়ে আবার কখনো সংগঠিত উপায়ে।
বর্তমান সময়ে যেখানে মানুষ হারিয়েছে জীবনযাপনের স্বাভাবিকতা।অনেক পরিবার আজ অর্থনৈতিকভাবে গভীর সংকটে মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজেদের শক্তি আর সামর্থ দিয়ে এগিয়ে এসেছে নেত্রকোনা এলকার গ্রামীণ নারীরা। বারসিক নেত্রকোনা রিসোর্স সেন্টারের উদ্যোগে নেত্রকোনা এই এলাকার করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় গ্রামীণ নারীর ভূমিকা বৃঝতে ১৪০টি গ্রামের প্রায় ৬৫০ জনের সাথে কথা বলা হয়। তাদের প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, এই করোনা পরিস্থিতি মোকাবেরায় গ্রামীণ নারীরা পারিবারিক পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করেছেন।বাড়ির চারপাশসহ পরিবারের যেটুকু জমি আছে সেখানেই খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগি হয়েছেন। কৃষাণী পরিবারে যাদের অল্প একটু জমি আছে তারাও চেষ্টা করছেন বৈচিত্র্যময় সবজি চাষের। কারণ কৃষি নির্ভর করে আবহা্ওয়ার উপর ভিত্তি করে। কোন একটি নষ্ট হলে অন্য ফসল দিয়ে ক্ষতি পূরনের আশা করেন।এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হয়ে উঠেছে বীজ সংকট। এই সংকট মোকাবেলায় তারা নিজেদের মধ্যে বীজবিনিময় প্রক্রিয়াকে জোরদার করেছেন। এভা্বেই নিজের চাহিদাটুকু মেটানোর পরে অতিরিক্ত বিক্রি করে নিজেদের প্রয়োজন যেমন মিটাচ্ছেন তেমনি খাদ্য সংকট থেকে রক্ষা করছেন নিজ সমাজসহ সমগ্র বাংলাদেশকে।
শস্যফসল উৎপাদন ছাড়াও তারা চেষ্টা করছেন কয়েটা হাসঁ-মুরগি পালনের। এই করোনা মহামারীতে গ্রামীণ নারীরা সামনের সারির যোদ্ধা না হলেও নিজস্ব জ্ঞান, দক্ষতা চর্চা ও শ্রম দিয়ে নিজের জন্য খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি সকলের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় রেখে চলেছেন অসামান্য অবদান। দেশের এই মহামারীর সময়ে অন্যরা যেন খাদ্য সংকটে না পড়েন সেই জন্য অধিক খাদ্য উৎপাদনসহ, প্রাণিসম্পদ পালন, বাড়ির চারপাশাকে পরিস্কিার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করার পাশাপাশি নিচ্ছে নানা ধরনের পদক্ষেপ।গ্রামীণ নারীর এই উদ্যোগগুলোই চলমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার এক অসামান্য অবদান।
এইন করোনা পরিস্থিতিতে নেত্রকোনা এলাকার গ্রামীণ নারীরা সংসারের কাজের পাশাপাশি নিজেদের অল্প জমিতে কেউ আবার বসতভিটায়, ভিটার আশপাশে বৈচিত্র্যময় শাক-সবজি চাষ করছেন। গ্রামীণ নারীরা যেসব কাজগুলো করে এসেছেন নিরন্তরভাবে তা হলো: হাসঁ, মুরগি, গরু, ছাগল, কবুতর পালন, বীজ সংগ্রহ, বীজ বিনিময়, অচাষকৃত উদ্ভিদ থানকুনি, কলমীশাক, বাসক পাতা দিয়ে ঔষধ, গাছের লতা পাতা দিয়ে ঔষধ তৈরি ও ব্যবহার, শাক-সবজি পরিচর্যা, গৃহপালিত পশু-পাখির যত্ন, বাড়ি ঘর পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, খাবার দেওয়া ও রান্না জন্য লাকড়ি/জ্বালানি সংগ্রহ, পানি সংগ্রহ, কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করা ,সবজির জন্য মাঁচা তৈরি করা, জমিতে জমে থাকার পানি নিংস্কাশন ব্যবস্থা করা, মাস্ক তৈরি ও বিক্রি, ফলজ, ঔষধি চারা রোপন, গৃহপালিত পশু-পাশির ঔষধ সংগ্রহ ও ব্যবহার, নারীরা বাড়ির প্রবীণ ও শিশুদের যত্ন করা, ভার্মি কম্পোষ্ট তৈরি ও বিক্রি , মাঠির জিনিস তৈরি ও বিক্রি করা, ঘরে রাখা আসবাবপাত্র রোদে দেয়া, রং করা, সেলাইকাজ করা, করছে। মৌসুমী ফল, হাঁসের বাচ্চা-মুরগির বাচ্চা ফোটানো, বাচ্চাদের আলাদা যত্ন করা, কাঁথা সেলাই করা, ব্যাগ তৈরি করা, ধান সিদ্ধ করা, চাল ঝাড়া, হাত ধোয়ার জন্য সাবান-পানির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি নানান ধরনের কাজ করছেন।
নারীদের এই কাজগুলোর কারণেই করোনা মহামারি সংকটে প্রতিটি কৃষিনির্ভর পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা পাচ্ছেন সেই সাথে এই মহামারীর সময়ে সকলের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবদান রাখছে। সেই সাথে গ্রামের নারীরা নিজেদের সফল উদ্যোগগুলো নিয়ে দাড়িঁয়েছে সমাজের অসহায় পরিবারের পাশে। এই সময়ে তারা ৩৫০টি পরিবারের মধ্যে সবজি বিতরণ করেছেন, ধোয়াজনিত শ্বাসকষ্ট রোধে এলাকার দক্ষ নারীরা প্রতিবেশিদের ধোয়াবিহীন চুলা বানিয়ে দিচ্ছেন, ১৫৩০ পরিবার নিজেদের মধ্যে বীজ বিনিময় করেছেন, নিজেরা প্রায় ১২০০ মাস্ক তৈরি করে প্রতিবেশিদের সহযোগিতা করেছেন। এভাবেই নেত্রকোনা এলাকার গ্রামীণ নারীরা এই মহামারী মোকাবেলা নিজেদের শক্তি আর সাহস দিয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অতিপ্রিয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের পাশে।