বৃষ্টি নামলে বাড়ি ফিরব
রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার মাদারীপুর গ্রামের শ্রীকান্ত রামদাস (৪২) ও তাঁর দলকে নিয়ে কাজের সন্ধানে রাজশাহীর পবা উপজেলার দুয়ারি গ্রামে এসেছেন। উদ্দেশ্য, দুয়ারী গ্রামের এ সময়ের চৈতালী ফসল ঘরে তুলে দেওয়া ও বোরো ধান লাগানোর কাজ পাওয়া। তার আগের গল্প হচ্ছে নিজ এলাকা নিয়ামতপুরে বোরো ধান লাগানো শেষ বলে সেখানে আর কাজ নেই। পাশাপাশি পানীয় জলের সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে। পরিবার নিয়ে কাজ না থাকায় সংকটে পড়েছেন তারা। তাই নতুন এলাকায় কাজের উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের এ বাড়ি ছাড়া। আবার নিজ এলাকার থেকে এই নতুন এলাকায় কাজ বেশি এবং নারী ও পুরুষের কাজের মজুরি বেশি এবং সমান। তাই এখানে তারা আসছেন কাজ এবং বেশি মজুরি পাওয়ার আশায় যাতে সংসারটা ভালো চলে।
তাঁদের সবারই বসবাস একটি বড় আম বাগানের নিচে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সবাই যেন বেঁদে। কিন্তু কাছে গিয়ে গল্পের মাধ্যমে জানতে পারা যায়, তাঁরা সনাতন ধর্মের রামদাস সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁদের ১০টি পরিবার ঘর ছেড়ে এখানে এসে একটি অস্থায়ী ঝুপরী ঘরে বসবাস করছেন। পাশে একটি পুকুর আছে। সেই পুকুরের পানি দিয়েই তারা সব কাজ চালিয়ে দেন। খাওয়ার পানি আনতে হয় পাশে একটি মুসলিম পরিবার থেকে। পরিবারটি সকল ক্ষেত্রে তাঁদের সহযোগিতা করে। শ্রীকান্ত রামদাসের স্ত্রী মালতি বালা (৩৮) বলেন, ‘আমাদের ওখানে এ সময়ে ¯œানের জল পাওয়া কষ্টের। এখানে অন্তত একটি পুকুর আছে।’ ১০টি পরিবারের সবাই মিলে মোটামুটি একটি পায়খানা তৈরি করে নিয়েছেন। সেটাই সবাই মিলে ব্যবহার করেন।
গল্পে গল্পে একে একে ঝুপরি থেকে বের হয়ে এলেন হরেন রামদাস, সুখেন রামদাস,আরতী, লীলাবতী, ঝালোবতিরা। নিয়ামতপুর এলাকায় তাঁদের পারিশ্রমিক বিষয়ে কথা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে লীলাবতী রানী বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এক বেলা কাজের জন্য পুরুষরা পেত ২৫০-৩০০ টাকা আর আমাদের একই কাজের জন্য দেওয়া হতো ১৫০ টাকা। আবার সব সময় কাজও থাকে না।’ এবার শ্রীকান্ত রামদাস বলেন, ‘আমরা ৫ বছর হবে এভাবে এখানে এসে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি। এখানে আমরা আসি বাংলা ফাল্গুন মাসের শুরুতে যখন আমাদের ওখানে কাজ কমে যায়। এ সময় আমাদের ওখানে জলের অভাবও দেখা দেয় পুকুর শুকিয়ে যাওয়ার কারণে। আবার যখন বৃষ্টি নামবে এদিকে কাজ কমে যাবে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের দিকে আমরাও ফিরে যাব আমাদের নিজের বাড়িতে।’ এই ছয় মাসে সব খরচ বাদে কত টাকা করে নিয়ে যেতে পারবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানেও তো একটি সংসার চালাতে হয়। তাই সব খরচ বাদে ১৫-২০ হাজার টাকা নিয়ে যেতে পারবো।’
এর মাঝে তিনজন এসে বসলেন। তাঁরা হচ্ছে রমেশ হে¤্রম, চরণ সরেন ও দুলু কিস্কু। তিনজনের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার শেষ সীমানা গাল্লা গ্রামে। এর পরেই শুরু হয়েছে নিয়ামতপুর উপজেলা। তিনজনই এখানে পরিবার ছেড়ে কাজের উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন। পেতেছেন ব্যাচেলর জীবন! মানে ব্যাচেলর কৃষি শ্রমিক হয়ে এভাবে আসছেন ৬-৭ বছর ধরে। নিজেরাই মিলেমিশে রান্না করেন একসাথে কাজে যান। এখানে দেখা গেল সাঁওতাল ও সনাতন ধর্মের একটি মিলনমেলা, যা আধুনিক সমাজে কল্পনা করা যায় না। কারণ কিছু কিছু সময়ে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করে। একই পুকুরে গোসল করে। এ বিষয়ে চরণ সরেন (৪২) বলেন, ‘আমরা ছয়মাস এক জায়গায় থাকতে থাকতে আমাদের মধ্য একটি আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে।’ দুলু কিস্কু (৪৫) বলেন, ‘আমরা গত বছর নিয়ামতপুরে শ্রীকন্ত দাদার মেয়ের বিয়েতেও গিয়েছিলাম।’
প্রকৃতি কিছু মানুষকে আজ ছয়মাস ঘরছাড়া করেছে। প্রয়োজনের তাগিদে সেখানকার মানুষগুলো ধর্মের বাঁধা ভুলে মিলেমিশে বসবাস করছেন। আবার অন্যভাবে ভাবলে তাঁদের ঘরছাড়ার দায় কিন্তু আমাদেরও আছে। আমরা পানির অপচয় রোধ করলে হয়তো আগামীতে এই মানুষগুলোই নিজের ঘরে আনন্দে বসবাস করতে পারবেন। আর এভাবে চলতে থাকলে হয়তো তাঁরা সারাবছরের জন্যই ঘর ছাড়া হয়ে যাবেন। এর দায় কি আমরা এড়িয়ে যেতে পারব?