পুকুর পাড় রক্ষায় তাহমিনা বেগমের কৌশল

সাতক্ষীরা, শ্যামনগর থেকে জেসমিন আরা, বিশ্বজিৎ মন্ডল, মফিজুর রহমান ও বাবলু জোয়ারদার

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুর এর পদ্মপুকুর গ্রামে বাস করেন তাহমিনা বেগম। তাঁর ৫ শতকের ভিটেবাড়ি রয়েছে। এই স্বল্প পরিমাণ বসতভিটায় তিন ভাইয়ের বসবাস। ভিটার সামনেই পুকুর। আইলার পরে বছর বছর পুকুরের পাড় ভাঙে। পাড় ভাঙতে ভাঙতে ঘরের গায়ে এসে লেগেছে। এভাবে পাড় ভাঙতে থাকলে এক পর্যায়ে তাহমিনা বেগমের ঘরবাড়িও ভেঙে পুকুরের মধ্যে পড়বে এমন অবস্থা। নিজের ঘরবাড়ি রক্ষা ও পুকুরের পাড় টিকিয়ে রাখতে ফশফন ২০১৪ সালে পুকুর পুনঃখনন করে পাড়ে মাটি দেন এবং এই মাটি ধরে রাখতে একই গ্রামের শহীদ গাজীর অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। পাড়ে দেওয়া নরম মাটিতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘাস সংগ্রহ করে লাগিয়ে দেন। দুই বছর হলো তিনি পুকুর পাড়ে ঘাস লাগিয়েছেন। ঘাস লাগানোর ফলে তিনি যেটা লক্ষ্য করেছেন পাড়ের মাটি ধুয়ে যাওয়া অনেক কমে গেছে। তাছাড়া এই ঘাস তিনি কেটে নিয়ে ছাগলের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারছেন এবং পুকুরের নীচের অংশের ঘাস মাছের খাদ্য হিসেবে ভূমিকা রাখছে। মাঝে মাঝে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন এই ঘাস। অথচ আইলার পর থেকে তিনি নানা কায়দায় চেষ্টা করেছেন পুকুরের পাড় রক্ষা করতে! তবে তাতে তিনি সফল হতে পারেননি!

Ai-1
অতীতে পুকুরের পাড় রক্ষার জন্য তাহমিনা বেগম কি কি করেছেন কিংবা আইলার পর এলাকার অবস্থা কেমন ছিলো তা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “আগে প্রায় জায়গায় ঘাস ছিল। কারণ তখন মাটিতে এতো নোনা ছিল না। আইলার বিষাক্ত লবণ পানি দীর্ঘদিন জমে থাকার কারণে সব ঘাস মরে যায়। আর লবণ পানি বেশি স্থায়ী থাকার কারণে মাটির শক্তিও কমে যায়। আইলার পরে কোন ঘাসের চিহ্ন ছিল না। অতিরিক্ত নোনায় ঘাসের গোড়া পঁচে ঘাস একেবারে মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।” তিনি আরও বলেন, “আইলার পানি সরে গেলে নতুন করে ঘরবাড়ি ঠিক করা হলো, পুকুরের পাড় নতুন করে বেঁধে নেয়া হলো কিন্তু মাটি পাড়ে দাঁড়ায় না। পুকুরের পাড় ঠিক রাখতে এবং পাড়ে মাটি ধরে রাখার জন্য বাঁশ কিনে পাইলিং করা হলো তাতেও পাড়ের মাটি ধরে রাখা যায় না। মাটি ধুয়ে নেমে যায়। ফলে একদিকে পুকুরে পলি জমে আবার অপরদিকে পাড়ের প্রশস্ততা কমে গিয়ে চলাচলের সমস্যা হয়। একে তো আইলায় সব শেষ তার উপর বছর বছর বাঁশ কিনে পাইলিং করা এবং পুকুরের মাটি কাটানো অনেক খরচের হয়ে পড়ে। তবে ঘাস লাগানোর পর পাড় ভাঙে কম।”

ঘাস মাটি ধরে রাখে এবং মাটির লবণ কাটাতেও সাহায্য করে। পুকুর পাড়ের মাটি রক্ষার কৌশল হিসেবে তিনি তাই ঘাস লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মাটি ধরে রাখার ক্ষেত্রে ঘাস দারুণ উপকারী এমনই ধারণা তার। পুকুরের পাড়ের মাটি ধরে রাখার ক্ষেত্রে তার এ ধারণা ও উদ্যোগের প্রমাণও তিনি পেয়েছেন। তাহমিনা বেগমের উদ্যোগের সফলতায় পাশ্ববর্তী আম্বিয়া বেগম তার পুকুরের পাড়ের ভাঙন রক্ষায় ২০১৬ সালে পুকুর পুনঃখনন করে পাড়ে ঘাস লাগিয়েছেন। লবণ ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় যাদের বসবাস তারা মাটি ধরে রাখার ক্ষেত্রে তাহমিনার এই উদ্যোগ গ্রহণ করলে সফলতা পাবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

Ai-2
উল্লেখ্য যে, উপকূলীয় পদ্মপুকুর ইউনিয়ন একটি দ্বীপ ইউনিয়ন। চারপাশ নদী দ্বারা বেষ্টিত। বিগত ২০০৯ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলায় ইউনিয়নটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভেড়ীবাঁধ ঠিকমতো না বাঁধতে পারার কারণে প্রায় দুই বছর ধরে জোয়ারের লবণ পানি পদ্মপুকুর গ্রামে আসা যাওয়া (জোয়ারে গ্রামের মধ্যে পানি ঢুকে যায় আবার ভাটায় পানি চলে যায়) করে। এছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন ও নদীকূলবর্তী হওয়ায় নানা ধরনের দুর্যোগ এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে সংগ্রাম করে জীবন টিকিয়ে রাখতে হয় এখানকার মানুষের। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সংগ্রাম তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করেছে। এ সংগ্রাম থেকে প্রতিনিয়ত তারা রপ্ত করে চলেছে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে টিকে থাকার এক একটি নতুন কৌশল। পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পদ্মপুকুর গ্রামের তাহমিনা বেগমের ঘাস লাগিয়ে পুকুর পাড়ের মাটির ভাঙন/ ধুয়ে যাওয়া রোধ করা ঠিক তেমনি একটি জ্ঞান ও কৌশল। দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর এধরনের নিজস্ব জ্ঞান ও কৌশল উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার সংগ্রামকে আরু বেশি শক্তিশালী করে তুলবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

happy wheels 2