একজন উদ্যোগী যুবক সালমান
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
নেত্রকোনা জেলার আমতলা ইউনিয়নের উদ্যোগী যুব সালমান। দরিদ্র কৃষক পরিবারের চার ভাইবোনের মধ্যে সালমান তৃতীয় সন্তান। সালমান একজন বিশেষভাবে সক্ষম যুবক। জন্ম থেকে দুই পা চলাচলে অক্ষম। হাটু পর্যন্ত অধেক পায়ের অধিকারি সালমান দুই হাটু ও হাতের উপর ভর করে চলতে শিখেন।
কঠোর মনোবলের অধিকারী
ছেলেবেলা থেকে নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করতো। পা না থাকলেও কারো উপর নির্ভর করে চলা পছন্দ করতো না । দুই হাত ও হাটুর উপর ভর করে মাকে কষ্ট না দিয়ে নিজের সকল কাজ করার সাথে সাথে পরিবারের কাজে সহায়তা করতো। ভাই বোনদের স্কুলে পাঠানো হলেও কিন্তু সালমানকে স্কুলে দেওয়া হলো না। ভাই বোনদের পড়ার বই পড়ে সালমান বাংলায় লিখতে ও পড়তে শিখে নেয়। পরিবারের সকলের সহযোগিতা না পেলেও সালমানের মা সব সময় পাশে থেকেছে। সালমানের এখন বয়স প্রায় ২৫ বছর। ভাই বোন সবাই নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে নিয়ে তার ছোট সংসার।
মেধাবী সালমান
যে কোন কাজ একবার দেখে শিখে নিতে পারে। বিশ্বনাথপুর গ্রামে প্রতিটি বাড়ি কৃষির সাথে জড়িত তাই সেলু মেশিনে জমিতে পানি দেওয়ার কাজ চলে প্রতি মৌসুমে। তবে গ্রামের কৃষকদের একটা বড় সমস্যা সেলু মেশিন নষ্ট হয়ে গেলে বিশ্বনাথপুর ও পাশ্ববর্তী গ্রামে মেশিন মেরামত করার মতো লোক না থাকায় প্রায় সময় কৃষি কাজে ব্যাহত হয়। নেত্রকোনা সদর থেকে লোক এনে মেশিন ঠিক করাতে খরচ পরে অনেক। গ্রামের এ সমস্যা সালমানকে সেলুমেশিন মেরামত করার কাজটি শেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। তাই এ কাজে দক্ষতা অর্জনে গ্রামের যেখানে মেশিন নষ্ট হতো সেখানে ছুটে যেত, কি ভাবে মেশিন ঠিক হচ্ছে তা দেখার জন্য। সালমান খুব অল্প সময়ে সেলু মেশিন মেরামত করার কাজে দক্ষ হয়ে উঠে। কিন্তু পায়ে সমস্যার কারণে সালমান গ্রামের বাইরে কোন কাজ করতে পারছিলেন না । সালমানের জীবনমূখী বিভিন্ন কার্যক্রম আগ্রহ দেখে স্থানীয় একটি এনজিও সালমানকে একটি হুইল চেয়ার কিনে দেয় যা সালমানকে গ্রাম ছাড়িয়ে অন্য গ্রামে মেশিন মেরামতে পাশাপাশি নানামূখী কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
প্রশিক্ষক
বারসিক দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্বনাথপুর গ্রামকে একটি সবুজ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ গ্রামের সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে কাজ করছে। সালমান বারসিক’র মাধ্যমে নিজেস্ব পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতের ইঁদুর দমন বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করে। একবারে প্রশিক্ষণে সালমান এতটা দক্ষ হয়ে উঠে যে বারসিক’র উদ্যোগে ভিন্ন গ্রামে কৃষকদের ইঁদুর দমনে প্রশিক্ষণে দেওয়া শুরু করে। যা স্থানীয় কৃষকদের কাজে সালমানকে জনপ্রিয় করে তুলে।
একজন বৈচিত্র্যময় ফসল চাষী
সালমান ছেলেবেলা থেকে সবজি ও বাড়ির চারপাশে বৃক্ষরোপণে আগ্রহ ছিল। তার নিজস্ব জমি না থাকায় প্রতিবছর অন্যের জমি বন্ধক নিয়ে সবজি চাষ করে। চলতি বছর ৮ কাঠা জমিতে সবজি ও ভুট্টা চাষের প্রস্তুতি নিয়েছে। শারীরিকভাবে অক্ষম থাকায় সবজির জমি প্রস্তুত করতে পারছিল না। সালমানের এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে গাছগড়িয়া গ্রামে বারসিক’র উদ্যোগে গড়ে উঠা গাছগড়িয়া যুব সংগঠনের সদস্যরা। তারা সকলে মিলে জমি প্রস্তুত করে দেয়। সালমান চারা রোপণ করে নিজেই বর্তমানে পরিচর্যা করছে।
প্রাণীসম্পদ পালনকারী
সালমানে সারাবছর বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গরু পালন করে, যা নিজেদের পরিবারের চাহিদা পূরণ করে মাঝে মাঝে বাজারে ডিম, হাঁস, মুরগি বিক্রয় করে। তার এ পশু পালন দেখে গ্রামের অনেক যুব বাড়িতে পশু পালনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। পশু পালনে কাজটিকে সফল করে তুলতে সার্বিকভাবে সহায়তা করছে বারসিক।
সবজি বিক্রেতা
সালমান একজন পুষ্টির ফেরিওয়ালা। যে হুইল চেয়ারটি উপর ভর করে চলা ফেরা করে সেই চেয়ারটিতে গ্রামের কৃষাণীতে বাড়ি থেকে সবজি, হাঁস, মুরগি এনে বাজারের বিক্রয় করে। এতে কৃষাণীরা খুশি হয়ে যা দেন তাই নিয়ে নেয় সালমান। সালমানে এ কাজ গ্রামে অনেক কৃষাণী বসত ভিটায় সবজি ও হাঁস, মুরগি পালনে আগ্রহী করে তুলেছে। কারণ গ্রামের নারীরা বাজারে বিক্রয় করতে পারে না বলে অনেকে অধিক পরিমাণ সবজি চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বসতভিটায় সবজি চাষের পাশাপাশি সালমান মাঝে মাঝে নদীর পাড় থেকে ভিন্ন ধরনের কুড়িয়ে পাওয়া শাক সংগ্রহ করে বিক্রয় করে যা মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ও রোগ বালাই দমনে কাজে লাগে। সালমানের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে কৃষি অফিসের যুক্ততা তৈরিতে কাজ করছে বারসিক। চলতি মৌসুমে সবজি চাষে প্রয়োজনীয় বীজ ও উপকরণ দিয়ে সহায়তা করবে উপসহাকারী কৃষি কর্মকর্তা।
যুব সমাজের অবক্ষয়ে আমাদের সমাজ এখন বড় সংকটে। প্রতিটি গ্রামের অভিভাবকরা নিজের সন্তান নিয়ে উৎক›ঠায় দিন কাটায় । জন্ম থেকে শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়া সত্বেও উদ্যোগী যুব সালমানের কাজ অনুপ্রেরণা হয়ে বিশ্বনাথপুর গ্রাম ছাড়িয়ে অন্যান্য গ্রামের যুবদের জীবনমূখি কর্মকান্ডে আগ্রহী করে তুলেছে। সালমানের কাজগুলোকে আরও সফল করে তুলতে প্রয়োজন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা। একটু সহযোগিতা সালমানকে জীবনে আর সফলতা করে তুলবে যা আমাদের সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে।