সাম্প্রতিক পোস্ট

তরুণদের সাহসী ভালোবাসায় টিকে গেলো বট-পাইকড়ের সংসার

তরুণদের সাহসী ভালোবাসায় টিকে গেলো বট-পাইকড়ের সংসার

রাজশাহী থেকে মো: শহিদুল ইসলাম
‘বটবৃক্ষের মায়া যেমন রে মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে’-বাংলার জনপ্রিয় এই লোক সংগীতের ভালোবাসার মতো ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলো বরেন্দ্র অঞ্চলের তরুণ-যুবরা। তাঁরা প্রেমে পড়েছে বট-পাইকড়ের সংসার টিকিয়ে রাখতে, তাঁরা বট-পাইকড়ের সংসার ভেঙ্গে দেবার খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়েছে তাদের (গাছগুলোর) কাছে, বট-পাইকড়কে হত্যা করতে যারা অবুঝের মতো পরিকল্পনা করেছিলো, ভালোবাসা আর নানা বুঝের মধ্য দিয়ে সেসকল অবুঝ মানুষের বিরুদ্ধে সমাধান এনেছে রাজশাহীর তরুণ-যুবরা। বট-পাইকড়ের সংসার টিকিয়ে রাখতে তরুণ-যুবরা দিকবিদিক ছুটেছে। অবশেষে বট-পাইকড় তাদের জীবন রক্ষা পেয়েছে, দিব্যি সংসার চালিয়ে যাচ্ছে তারা এই প্রকৃতির ঘরে।

খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের বড়গাছি বাজারে অর্ধশত বছরের বেশি সময় থেকে বট-পাইকড় সংসার পেতেছে। তাদের এই সংসারে, পরিবারের সদস্য এই প্রকৃতির যেন সব কিছু। বট-পাইকড়ের ডালে ডালে হাজারো পাখির বসবাস, গাছের ফল থেকে পাখিদের আহার, খাদ্য গ্রহণ, রাত্রীবাসসহ আরো কতো জানা অজানা, দেখা অদেখা প্রাণীর বসবাস এই বট-পাইকড় গাছগুলোতে। বছর বা মৌসুমে গাছের ডালে পাখিসহ অন্যান্য গাছের সকল প্রাণীদের প্রজনন ও বংসবৃদ্ধিসহ উত্তপ্ত ও তীব্র তাপদহের মধ্যে একটি জুড়িয়ে নেয়া, ঝিরি বাতাসে গা এলিয়ে দেয়া সব মিলেয়ে যেন সবার সংসার এক জায়গায় এসে মধুর থেকে মধুময় হয়ে যায়। বিকাল হলে সেখানে গ্রামের প্রান্তিক চাষিরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে বট-পাইকড়ের ছায়ায় এসে গ্রামের হাট বসান, কেনা বিক্রি হয়। গাছের ছায়ার নীচে মুদি দোকানসহ চায়ের আড্ডায় জমে উঠে গ্রামীণ মানুষের মিথস্বিক্রয়া এবং তথ্য ও বিনোদন বিনিময়ের এক প্রাচীন ঐতিহ্য। মহুর্তে যেন সবকিছু শেষ করতে চায় এই ঐতিহ্যের এবং প্রাকৃতিক আয়োজন। বুঝেও যেন না বুঝের মতো, সামান্য স্বার্থের কারণে মানুষগুলো কেটে ফেলতে চায় এই বট-পাইকড় গাছগুলো। পক্ষ বিপক্ষের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়ে তরুণদের ভালোবাসায় বট-পাইকড় এখনো সংসার করছে। কোন আঁচড় পড়তে দেয়নি তাদের শরীরে দেহে, ডালে ও পাতায়।

কিভাবে টিকলো এই সংসার
ঘটনার শুরু ১৫ জুলাই ২০২৩ তারিখে। স্থানীয় যুব সংগঠনের তরুণদের মাধ্যমে খবর আসে বড়গাছি বাজারের বট-পাইকড় গাছ দুটি কাটার জন্য গাছের গোড়ার মাটি সরানো হচ্ছে। সেখানে এক্সাভেটর (ভেকু) মেশিন দিয়ে গাছের বেশির মাটি সরানো হচ্ছে। তাৎক্ষণিক বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামসহ ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ এর কার্যকরি কমিটি যুবকরা সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পান, বট-পাইকড় গাছের বেদিও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে গাছ কাটার উদ্দেশ্যে। এমনকি সেখানে গাছের নিচে এক্সাভেটর (ভেকু) যন্ত্রও রাখা হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ভয়ের কারণে জনগোষ্ঠী সরাসরি প্রতিবাদ করতেও ভয় করছেন। তারা জানতে পারেন সরকারি জায়গাটিতে মার্কেট করার লক্ষ্যে গাছগুলো কাঁটা হবে। যুবকরা তাৎক্ষণিক গাছ কাটছে যারা তাদের সাথে আলোচনা পরামর্শ দেয় গাছগুলো কাটার বিপক্ষে। কিন্তু অবুঝের মতো তারা গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্তেই অনড় থাকে। তখন উপায়ান্তর না পেয়ে তরুণ-যুবরা রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করে তাঁকে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। একইসাথে সেটি স্থানীয় পবা উপজেলার নির্বাহী অফিসারকেও তারা স্মারকলিপি প্রদান করেন গাছগুলো কাটার বিরুদ্ধে। রাজশাহী জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিক বিষয়টি পবা উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করেন, গাছগুলো কাটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বলেন। এ পর্যন্ত গাছগুলো আপাতত রক্ষা পায়। কিন্তু একমাস না পেরোতেই আগস্ট মাসের দিকে আবার খবর আসে গাছগুলো কাটার জন্য চেষ্টা করছে অবুঝের সেই মানুষগুলো। আবার তরুণ-যুবরা জেলাপ্রশানকে বিষয়টি অবহিত করলে জেলা প্রশাসন থেকে টিম পাঠিয়ে দিয়ে গাছগুলো না কাটার জন্য তীব্রভাবে নির্দেশনা জানিয়ে আসেন। সে পর্যন্ত এবং এখন পর্যন্ত গাছগুলো রক্ষা পেয়েছে। এখনো দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে বট-পাইকড় গাছগুলো। শুধু জোড়া বট-পাইকড় দুটি নয়, বড়গাছি বাজারে আরো ৫টি তরুণ বয়সী বট পাইকড় গাছও রক্ষা পেয়েছে।

তরুণদের দাবি- বাজারের উন্নয়ন হোক বট-পাইকড়সহ অন্যান্য গাছগুলো অক্ষত রেখেই। কারণ, বট-পাইকড় গাছের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির খাদ্য ও বাসস্থানের সুযোগ করে দেয়। এ ছাড়াও মানুষ এই গাছের ছায়ায় এসে জুড়িয়ে নেয়, গাছের ছায়ায় বিকালে গ্রামের কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য এসে বিক্রি করে। সবমিলিয়ে পরিবেশ, সাংস্কৃতি সুরক্ষায় এই গাছগুলোর অবদান অনেক। তাই গাছগুলো অক্ষত এবং জীবন্ত থাক, বট-পাইকড়ের সংসার টিকে থাক সেই কামনা এলাকার জনগোষ্ঠীর। বৃক্ষগুলো সুরক্ষা বিষয়ে বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের সভাপতি শাইখ তাসনীম জামাল বলেন, “এমনিতেই বরেন্দ্র অঞ্চলে দিনে দিনে তীব্র তাপদহ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনাবৃষ্টির সময় বেড়ে গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের আঞ্চলিক অভিঘাত বরেন্দ্র অঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে, আর এই সময়ে বৃক্ষ সুরক্ষা করা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।” তিনি আরো বলেন, ‘বৃক্ষ হত্যা বন্ধ করতে হবে, উন্নয়নের নামে আর কোন বৃক্ষ হত্যা করতে দেওয়া হবে, সকল উন্নয়ন হোক বৃক্ষকে সুরক্ষা ও অক্ষত রেখেই।’

happy wheels 2

Comments