শ্রম আর মেধা দিয়েই জয়
নেত্রকোনা থেকে তোবারক হোসেন খোকন
শীত পড়তে শুরু মাত্র, বাজারে শীতের নতুন সবজির চাহিদাও বেশি। আর সেগুলো যদি বিষমুক্ত বা কুড়িয়ে পাওয়া হয় তাহলে হাটে নেয়ার আগেই রাস্তা থেকে বিক্রি হয়ে যায়। তেমনি একজন বিষমুক্ত সবজি চাষী রহিমা খাতুনের (৪৬) স্বাবলম্বী হওয়ার গল্পই আজ শুনবো।
দুর্গাপুর পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত কদম আলীর স্ত্রী রহিমা খাতুন। ৩ বছর আগে স্বামী পরলোকগমন করেছেন। সরকারি সহায়তায় আবাসনের একটি ঘরে ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন রহিমা খাতুন। জীবন সংগ্রামী রহিমা খাতুন এর ছেলে বয়স ১৫বছর, আর মেয়ের ১৩। ছোট ছেলে মেয়ে রেখে স্বামী মারা যাওয়ায় মানুষের বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে দু-বেলা আহার জুটিয়েছেন। যে কারণে ছেলে মেয়ের পড়াশুনার কথা চিন্তাও করতে পারেনি।
নিজের কোন জমি না থাকায় নদীর পাড়ে পানি নামার সাথে সাথে প্রতিবছর কার্তিক মাস থেকেই শুরু হয় রহিমা খাতুনের অভিযান। লাল শাক, মুলা, নতুন আলু, সিম, ডাটা, ধনে পাতা ফলান তিনি। শীত মৌসুমের সবজি ফলানো শেষ হলে বছরে অন্যান্য সময়গুলো কাটান হাতে মুড়ি ভেজে।
সবজি বাগানের কথা বলতে গিয়ে রহিমা জানান, প্রথমে অন্য সবজি ফলানোর কথা চিন্তা করি কিন্তু বীজ কিনবো সে সামর্থ আমার নাই, তাই অল্প পুঁজিতে অনেকেই আমাকে সবজি বাগান করার জন্য বলেন। বাগান করার আগে বাজারে গিয়ে দেখেছি বিষমুক্ত সবজির দর ও চাহিদা একটু বেশি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘টেহার লাগিন ছেড়াডারে হড়াইতাম হারছিনা, ছেড়িডা দু¹াহুর বাজারো ডাক্তর এর বাড়ীত কাম হরে, কয়দিন হর আর কাম হরতে দিতাম না, একটা সিলাই মিশিন কিনবাম, মা-ঝিয়ে মিল্লা কাহড় সিলাই করবাম, আর ছেড়ারে বাজারো তরহারির দোহান ধইরা দিয়াম’’
গত বছর শেষ বৃষ্টির কারণে শীতের সবজির বেশ ক্ষতি হয়েছিল, তার পরেও সবজি বিক্রি করেছেন প্রায় ১২হাজার টাকা আর মুড়ি বিক্রি করেছেন ৬ হাজার টাকার। এভাবে সবজি ও হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রির উপর নির্ভর করেই তিনি এগিয়ে চলেছেন। গত বছরের সবজি বিক্রির লভাংশের টাকা দিয়ে একটা ষাড় বাছুর কিনেছেন, সামনের কুরবানীর ঈদে এই গরুটা বিক্রি করে ২টা সেলাই মেশিন আর কিছু কাপড় কিনে আবাসনে অন্যান্য বেকার মেয়েদের সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজেরাই স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন রহিমা। নিজের বাড়িটিকে একটি আদর্শ বাড়ি হিসেবে দেখতে চান। তিনি বলেন, “এবছর সব্জি বিক্রির টাকা দিয়ে একটি অটো রিক্সা কিনে ভাড়া দিবেন, যা থেকে তার সংসারে বাড়তি আয়ের যোগান দিবে।”
রহিমা খাতুন সবজি বাগানের পাশাপাশি খালি জায়গাগুলোতে পেঁপে ও কলার আবাদও করেছেন। গত বছর কলা ও পেঁপে বিক্রি করে ৪ হাজার টাকা লাভ করেছেন। এবছর নদীর পাড়ের খালি জায়গাগুলোতে তাঁর সবজি বাগানটি আরো সম্প্রসারিত করেছেন, তিনি সবজি ফলানোর পাশাপাশি সবজি চারা বিক্রি করারও উদ্যোগ নিয়েছেন। নতুন করে আলু ও মরিচের বীজ ফেলেছেন। নিজের জন্য যেটুকু দরকার তা রেখে বাকী সব বিক্রি করবেন বলে জানান। তার একটি ফুল ও ফলের চাড়া নিয়ে নার্সারি করারও একটি ইচ্ছা রয়েছে।
রহিমা খাতুনের সাজানো গোছানো সবজি বাগান দেখে আবাসনের অন্যান্য মহিলারাও এগিয়ে এসেছেন। এ সবই কিছুই সম্ভব হচ্ছে নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ধৈর্যের কারণে। সফলতার পূর্ণতা অর্জনের আলো উঁকি দিতে শুরু করেছে রহিমার স¦প্নের ঘরে। তিনি প্রমাণ করেছেন, শ্রম আর মেধা দিয়ে জয় করা যায় সকল অসম্ভবকে।