ভালোবাসা ছড়িয়ে যাক প্রাণ ও প্রকৃতিতে!
ঢাকা থেকে বাহাউদ্দীন বাহার
১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। প্রতিবছর সারা পৃথিবীর মানুষ ভালোবাসা দিবস উদযাপন করে ব্যক্তিক কিংবা সামষ্টিকভাবে। বিশেষ করে বয়োঃসন্ধিকালীন ছেলেমেয়ে এবং আপত তরুণদের মাঝে এই দিনটির বিশেষত্ব লক্ষ্যণীয়। এটির ইতিহাস, সাংস্কৃতিক পরিচয় কিংবা উদযাপনের ধরণ এবং ঢং নিয়ে রয়েছে হাজারো আলোচনা ও সমালোচনা। তবে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে-এই দিনটিতে সারা পৃথিবীতে এক ধরনের ‘পজিটিভ ভাইভ’ বিরাজ করে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এই পজিটিভ ভাইভটার খুব বেশি প্রয়োজন।
পৃথিবী তার সৃষ্টিলগ্নে ছিল উত্তপ্ত। তারপর ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে। সেই শীতল অবস্থা থেকে এই সবুজ পৃথিবীর ‘সবুজ অধিবাসী’রাই পৃথিবীকে বাসযোগ্য উষ্ণ করে তুলেছে। সবুজ অধিবাসী বলতে পৃথিবীতে বিরাজমান লক্ষাধিক প্রাণকে বোঝানো হচ্ছে। তারা তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অর্থাৎ জীবনধারণ এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য উষ্ণ করে তুলেছে। আজকের এই সভ্য পৃথিবীর দাবিদার যতটুকু মানুষ! ঠিক ততটুকুই কিংবা তারও অধিক দাবিদার বাদ বাকি প্রাণ। কিন্তু মানুষ নামক দাম্ভিক (!) প্রাণী নিজেকে ‘ফোকাস’ করতে গিয়ে আর সকল প্রাণকে ‘ডি-ফোকাস’ করে ফেলেছে। তাই তো পৃথিবীকে উষ্ণ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে বৈশ্বিক উষ্ণতার মতো সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা’র জন্য প্রাকৃতিক কারণ এর সাথে শুধু মানুষ্য সৃষ্ট কারণই জড়িত। অন্য কোন প্রাণ এর জন্য দায়ি নয়। কিন্তু এই বৈশ্বিক উষ্ণতার মতো সমস্যা সমাধানে মানুষের প্রয়োজন পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল প্রাণীর সহযোগিতা।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বলতে শুধু প্রাকৃতিক উষ্ণতাই নয়। এর সাথে সাথে সমাজিক-সাংস্কৃতিক উষ্ণতাকেও বিবেচনা করা হচ্ছে। দিনকে দিন এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান্তরালভাবে। যুদ্ধ, সন্ত্রাস, সামাজিক সহিংসতা, নির্যাতন, প্রতিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের মতো হাজোরো সমস্যায় জর্জরিত বর্তমান পৃথিবী এবং মানুষ। এই সমস্যার নেতিবাচক প্রভাব শুধু মানুষ একা ভোগ করছে না; অন্য প্রাণও সংকটের সম্মূখীন। কিন্তু একমাত্র মানুষই পারে এই সমস্যা থেকে উত্তোরণ করাতে। অন্য প্রাণ হতে পারে সহযোগী, সহযাত্রী; কিন্তু নেতৃত্ব মানুষকেই দিতে হবে।
ভালোবাসা দিবসে যে ‘পজিটিভ ভাইভ’ বিরাজ করে সেই পজিটিভ ভাইভটা হতে পারে এই বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক ধাপ। কিন্তু সেটি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আরো নির্দিষ্ট করে বললে শুধুই আমাদের ভালোবাসার মানুষ কিংবা সবচেয়ে নিকটজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেটি কী এই স্বল্প গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে? আসুন এই গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসি।
এই ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসা বিলিয়ে দেই আমাদের সবচেয়ে দূরত্বের সম্পর্কের মানুষের জন্য। যে ব্যক্তিটির সাথে আমাদের সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক; আসুন এই ভালোবাসা দিবসে তাকেই ভালোবাসি। তাকে একটি ফোন দিয়ে জানাই ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা। ভালোবাসা দিবসে আমরা ফুল ও চকলেট উপহার দিতে ভালোবাসি। সেই ‘শত্রু’কেই দিই ফুল আর চকলেট। দেখবো আমাদের জীবনটা আরো বেশি ভালোবাসায় ভরে উঠবে।
ভালোবাসা দিবসে আমরা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে চাই। চলুন না বিলিয়ে দিই যার সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা প্রয়োজন সেই মানুষটাকেই। হয়তো আপনার আমার পরিচিত কেউ মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত; তাকেই জানাই আমাদের ভালোবাসা। কিংবা আমাদের আশেপাশের হাজারো ভালোবাসা (!) বঞ্চিত মানুষ আছে- আসুন তাদেরকেই ভালোবাসি। ভালোবেসে ব্যবস্থা করি একবেলার খাবার- ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের পরিবর্তে। কিংবা প্রয়োজনীয় সেবা। আসুন ভালোবাসা দিবসে ছুটি নিয়ে-ভালোবাসার মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে সময় কাটাই কিছু ভালোবাসা বঞ্চিত নারী, শিশু এবং প্রবীণ নাগরিকের সাথে। ভালোবাসা দিবসে আসুন রক্ত দেই। কিংবা ব্যস্ত দিনের হাজারো ব্যস্ততার মাঝে একটি অন্তত ভালো কাজ করি।
ভালোবাসা কি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? আমরা কী শুধু মানুষ নিয়েই বেঁচে থাকি? মানুষ ছাড়াও আমাদের চারপাশে হাজারো বস্তুগত এবং অবস্তুগত উপাদান রয়েছে। সেই সমস্ত উপাদানগুলোকে কি ভালোবাসা যায় না? আমরা যে বায়ু গ্রহণের মাধ্যমে বেঁচে আছি-সেই বায়ুকে চলুন ভালোবাসি। দূষিত বায়ুকে কম দূষিত করি (কম কার্বণ নিঃসরণ করা) কিংবা বিশুদ্ধ করার (গাছ লাগানো) উদ্যোগ নিয়ে বায়ুকে ভালোবাসি। আসুন মাটিকে ভালোবাসি; কম রাসায়নিক সার-কীটনাশক ব্যবহার কিংবা মাটি দূষণ কম করে।
ভালোবাসার অন্য এক প্রতিশব্দ হয়তো ফুল। আমরা প্রতিবার ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসার মানুষটিকে ফুল উপহার দিই-খুবই ভালো কথা। এবার ফুলটিকেই ভালোবেসে একটি ফুলগাছ লাগাই। যেন আগামী ভালোবাসা দিবসে ফুল কেনা না লাগে। কিংবা ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষটিকেই হয়তো একটি ফুলগাছই উপহার দিলাম।
ভালোবাসা দিবসে অনেকেই মানবতার জন্য রক্তদান ক্যাম্প, চিকিৎসা ক্যাম্প, অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করি। নিঃসন্দেহে খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীর জন্য স্বাস্থ্য ক্যাম্প কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় অর্থ সংগ্রহ করতে কী পারি না-এই ভালোবাসা দিবসটিকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে। আসুন ভালোবাসা দিবসে কিছু না পারি প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের অন্তত ক্ষতি হয় এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকি।
কেন ভালোবাসার এই গন্ডি ভাঙা জরুরি? কারণ মানুষ একা বাঁচতে পারে না। আর তাই মানুষের প্রয়োজনেই মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণ এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিক্ষা দিক এই সার্বজনীন ভালোবাসা দিবস। এই দিনের ‘পজিটিভ ভাইভ’ একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে আরো বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দিতে পারলেই এই দিনটির প্রকৃত তাৎপর্য ফুটে উঠবে। পাশপাশি, শুধু মানুষে-মানুষে সীমাবদ্ধ থাকলে এক সময় মানুষ ছাড়া আমাদের চারপাশে আর কিছুই থাকবে না। আবার শুধু ভালোবাসার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে আমাদের শত্রু সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। তাই ভালোবাসাতে হবে সবাইকে। আমাদের শত্রুকে; ভালোবাসা বঞ্চিত মানুষটিকেই। ভালোবাসতে হবে আমাদের চারপাশের প্রাণ, প্রকৃতি এবং প্রতিবেশকে। তবেই সম্ভব একটি ভালোবাসাময় পৃথিবীর। যেটি হবে আরো বেশি উপযোগী, স্বাচ্ছন্দ্য এবং টেকসই সকল প্রাণের জন্য।
** ছবিগুলো সংগৃহীত